মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিভিন্ন সংগঠিত গ্রুপের মধ্যে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শহুরে তরুণরাও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামছে। কারণ এক বছর আগে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে তাদের জীবনযাত্রা থমকে গেছে। তারা এই সামরিক শাসনের দমবন্ধ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে।
সাম্প্রতিক সহিংসতার তীব্রতা এবং ব্যাপ্তি থেকে ধারণা করা হচ্ছে মিয়ানমারের সংঘাত এখন নাগরিক বিদ্রোহ থেকে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে রুপ নিয়েছে।
সংঘাত মনিটরিং গ্রুপ ‘সশস্ত্র সংঘর্ষের অবস্থান এবং ইভেন্ট ডেটা প্রকল্প (Acled)’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতা এখন পুরো মিয়ানমারজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাওয়া প্রতিবেদনগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইটি ক্রমবর্ধমানভাবে সমন্বিত হয়ে উঠেছে এবং শহুরে কেন্দ্রগুলোতেও পৌঁছে গেছে। যেগুলো আগে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ দেখেনি।
গত আগস্ট মাসের পর থেকে প্রতিদিনই সংঘাত আরও মারাত্মক রুপ ধারণ করতে থাকে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা মঙ্গলবার জানিয়েছে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বছরব্যাপী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া দেশটিতে সশস্ত্র সংঘাতে আরও হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে একমত হয়েছেন যে, মিয়ানমারের সংঘাতকে এখন গৃহযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করা উচিত এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর চাপ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ‘শক্তিশালী পদক্ষেপ’ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন যে, মিয়ানমার সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া জোরালো ছিল না। মিয়ানমার পরিস্থিতিকে ‘বিপর্যয়কর’ আখ্যা দিয়ে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই সংঘাত এখন মিয়ানমার ছাড়িয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
সামরিক সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা দলগুলো সম্মিলিতভাবে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামে পরিচিত। পিডিএফ হল বেসামরিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। আর এই মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সদস্য মূলত তরুণরা।
পিডিএফ সর্বস্তরের মানুষ- কৃষক, গৃহিণী, ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে তৈরি। সামরিক শাসন উৎখাতের দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ।
দেশ জুড়ে নানা ইউনিট রয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কেন্দ্রীয় সমভূমি এবং শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জাতির যুবকরাই এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা অন্যান্য জাতিসত্তার যুবকদের সঙ্গে নানা বাহিনীতে যোগদান করছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো তরুণ বামারদের সহিংস বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে।
মিশেল ব্যাচেলেট বিবিসিকে বলেছেন, ‘প্রচুর বেসামরিক নাগরিক এই মিলিশিয়া বাহিনীগুলোতে যোগ দিয়েছে এবং এই জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনী বা পিডিএফ তৈরি করেছে। সুতরাং, এই কারণেই দীর্ঘদিন ধরে আমি বলে আসছি যে, আমরা যদি মিয়ানমার নিয়ে আরও জোরালোভাবে কিছু করতে সক্ষম না হই, তবে এর অবস্থাও মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ার মতোই হবে’।
জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) এর ইউনিটগুলোর পাশাপাশি পিডিএফ এর সদস্যরাও এখন সীমান্ত এলাকার জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় পাচ্ছে। কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী আগের সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল, সেই যুদ্ধবিরতি এখন ভেঙে গেছে।
পিডিএফ এখন প্রকাশ্যেই জাতিগত মিলিশিয়াদের কাছে ক্ষমা চাইছে। কারণ তারা এর আগে এই জাতিগত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর চালানো মিথ্যা প্রচারণা বিশ্বাস করেছিল। সামরিক বাহিনী প্রচারণা চালিয়েছিল যে, জাতিগত মিলিশিয়ারা দেশকে ভেঙে ফেলতে চায়। পিডিএফ এখন সকল জাতিগত বিদ্রোহীদের নিয়ে সর্বসম্মোতভাবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানাচ্ছে, যেখানে সকল জাতিগোষ্ঠির সমান অধিকার থাকবে।
Leave a Reply