ভারতে এই কাঠ এত বিপুল পরিমাণে কাটা এবং পাচার হয়েছে যে, আর মাত্র পাঁচ শতাংশ গাছ অবশিষ্ট রয়েছে।
২০১৫ সালে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের গভীর জঙ্গলে পুলিশি অভিযানে ২০ চন্দন চোরাকারবারি নিহত হয়।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন অন্ধ্র পুলিশের টাস্কফোর্স গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিল শত শত চোরাকারবারি ও কুলি রক্তচন্দনের বনে জড়ো হয়েছে।
তাদের ধরতে টাস্কফোর্স যখন জঙ্গলে হানা দেয়, তখন কুড়াল-ছুরি-পাথর-লাঠিসোঁটা নিয়ে চোরাকারবারিরা পুলিশকে আক্রমণ করলে তারাও পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
ঘটনাটি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে কারণ নিহতরা প্রায় সবাই পাশের রাজ্য তামিলনাড়ুর ইরোড ও ভেলর জেলার বাসিন্দা ছিলেন।
অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলার শেষাচলম জঙ্গলে মেলে ব্যয়বহুল রেড স্যান্ডালউড বা রক্তচন্দন। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক– এই তিন রাজ্যের সীমান্ত এসে মিলেছে এই ঘন জঙ্গলে। ফলে এখানে চন্দনের চোরাকারবার ঠেকানো প্রশাসনের জন্য দুরূহ।
ভারতীয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে জব্দ করা রেড স্যান্ডালউডের অর্ধেক নিলামে তুলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার প্রায় এক হাজার কোটি রুপি সংগ্রহ করেছিল। প্রতিবেদনে তামিলনাড়ুর কর্মকর্তাদের বরাতে উল্লেখ করা হয় যে, অন্তত ৪৫০ কোটি টাকার জব্দকৃত চন্দনকাঠ রাজ্যের গোডাউনে পড়ে আছে।
বিশ্ববাজারেও রক্তচন্দনের চাহিদা ব্যাপক। এক ব্যবসায়ী জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো জাতের রক্তচন্দন কাঠের দাম টনপ্রতি ৭০ লাখ রূপিও উঠতে পারে।
এই রক্তচন্দন কাঠের পাচার নিয়েই গড়ে উঠেছে সম্প্রতি হইচই ফেলে দেওয়া ভারতীয় তেলেগু ভাষার সিনেমা ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ এর চিত্রনাট্য।
আল্লু অর্জুন এবং রেশ্মিকা মন্দানা অভিনীত ছবিটিতে দেখানো হয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্র পুষ্পা কীভাবে এই কাঠ পাচার করে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। ‘পুষ্পা’ ছবিতেও শেষাচলম জঙ্গলের কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া তামিলনাড়ু লাগোয়া অন্ধ্রপ্রদেশের চার জেলা— নেল্লোর, কুর্নুল, চিতোর এবং কাডাপ্পা জেলাতে রক্তচন্দন গাছ মেলে। পূর্বঘাট পর্বতের আবহাওয়ায় এই গাছ খুব ভাল হয়। একেকটি গাছের উচ্চতা ৮-১২ মিটার।
দু’ধরনের চন্দনকাঠ পাওয়া যায়। সাদা এবং লাল। সাদা চন্দনে সুঘ্রাণ থাকলেও লাল বা রক্তচন্দনে কোনও গন্ধ নেই। কিন্তু এর কাঠের বিশেষ গুণের জন্য বিশ্বজুড়ে চাহিদা বিপুল। আর সেই চাহিদার কারণেই এই কাঠ পাচার হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০১৮ সালে এই গাছকে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত করেছে। ভারতে এই কাঠ এত বিপুল পরিমাণে কাটা এবং পাচার হয়েছে যে, আর মাত্র পাঁচ শতাংশ গাছ অবশিষ্ট রয়েছে।
কেন আলোচনায় বহুমূল্য এই গাছ
ভারতে রক্তচন্দনের আরেক নাম ‘লাল সোনা’। সোনার মতোই মূল্যবান বিরল প্রজাতির এই উদ্ভিদ।
আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে এই কাঠের বিপুল ব্যবহার হয়। ইনস্টিটিউট অফ উড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মতে, এই উদ্ভিদ শরীরকে শীতল করে, জ্বালাপোড়া কমায়, রয়েছে রক্ত শুদ্ধিকরণের গুণও। মাথাব্যথা, চর্মরোগ, জ্বর, ফোঁড়া, বৃশ্চিকের দংশনে চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত হয় রক্তচন্দন। দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতেও এর অবদান রয়েছে। পূজা-অর্চনা, প্রসাধনী দ্রব্য তৈরিতে অনেক আগে থেকেই রক্তচন্দনের ব্যবহার হয়ে আসছে।
ভারতীয় জার্নাল অফ অ্যাপ্লায়েড রিসার্চের মতে, বাদ্যযন্ত্র এবং বিলাসবহুল আসবাবের জন্য এই কাঠ ভাল কাঁচামাল।
তিরুপতির শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, রক্তচন্দন এক ধরনের রঞ্জক উৎপাদন করে থাকে যা খাদ্যে এবং ওষুধে ব্যবহারযোগ্য। এই গাছের বাকল এবং কাঠ থেকে প্রাপ্ত নির্যাসেরও বেশ কিছু ওষধি গুণ রয়েছে।
এমনকি জাহাজ নির্মাণেও রক্তচন্দন কাঠ ব্যবহার করা হয় বলে কিছু ভারতীয় ব্যবসায়ীর দাবি; নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের বিকিরণ কমাতে অবদান রাখে রেড স্যান্ডালউড।
২০০০ সালের দিকেই ভারতে এই উদ্ভিদের কাটা, বিক্রয় এবং রপ্তানিসহ সকল প্রকার কারবার নিষিদ্ধ করা হয়। তখন থেকে গাছটির চোরাচালানও বেড়ে যায়।
চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং অস্ট্রেলিয়ায় রক্তচন্দন কাঠের বিপুল চাহিদা। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা চীনে। তাই পাচারও বেশি হয় ওই দেশে।
অথচ নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে যেসব শ্রমিকেরা রক্তচন্দনের গোপন বাক্সপ্যাটরা সরবরাহের কাজে নিয়োজিত থাকেন, তারা নিজেরাই নাকি এই লাল কাঠের প্রকৃত দাম জানেন না!
আথিমুরের এক নিবাসী বলেন, “এই লাল কাঠের আসল ব্যবহার কী তা আমাদের কেউ বলেনি।”
ভেলর রেঞ্জের একজন বন কর্মকর্তা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, “এক টন লাল চন্দনের দাম ভারতে ২০ লাখ রূপির মতো, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্য উঠে যায় ৫০-৮০ লাখ টাকার ওপর।”
আগেই বলা হয়েছে, ভারতে এই গাছ কাটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তারপরেও পাচার বন্ধ নেই। জাহাজের কন্টেইনারে বা এয়ার কার্গোতে বেশিরভাগ সময়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই ‘খাদ্যপণ্য’ হিসেবে একে চালান করে দেওয়া হয়। আবার চেন্নাই থেকে কুয়ালালামপুর বা দিল্লি থেকে বেইজিং যাবার সময় বিমানের যাত্রীরা তাদের লাগেজে করেই রক্তচন্দন বহন করে থাকে।
রেড স্যান্ডার্সের পাচার নিয়ন্ত্রণে ভারতে ‘রেড স্যান্ডলার্স অ্যান্টি-স্মাগলিং টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। ২০২১ সালে ৫০৮ কোটি টাকার রক্তচন্দন বাজেয়াপ্ত করেছে এই স্পেশাল টাস্কফোর্স। গ্রেপ্তার হয়েছে ৩৪২ জন পাচারকারী।
যেকোন বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর বাণিজ্য বিধি থাকায়, যারা বৈধভাবে রক্ত চন্দনের ব্যবসার সাথে জড়িত তারাও মার খেয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই ইতিমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
যেসব কৃষকের জমিতে এখনো প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গুটিকতক রক্তচন্দনের গাছ রয়েছে, তাদের কাছ থেকেই বর্তমানে স্বল্প পরিমাণে কাঠ ও গুঁড়া সংগ্রহ করছেন ব্যবসায়ীরা।
Leave a Reply