মাহবুব পিয়াল,ফরিদপুর : ‘জীবনে অনেক শখ ছিলো নিজের একটা সংসার করবো। গৃহবধূ হয়ে সারাজীবন পর্দায় থাকবো। কিন্তু তা আর হলো না। আমাকে সকলে পাগল বলে। ভালো লাগে না আমার জানেন না। মাঝে মাঝে মনে হয় মইরা যাই।’
কথাগুলো বলতে একপর্যায়ে কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ হয়ে যায় ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের মেয়ে আঙুরি ওরফে সাথী সরকারের। ছোটবেলা থেকে কষ্টকে সাথী করে বেড়ে ওঠা আঙুরির জীবনটাই যেনো এক নির্মম জীবনের উপাখ্যান। তবে মুজিব শতবর্ষে তার একটি ঠিকানা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে সে জমিসহ এখন একটি ঘরের মালিক। তার এখন একটাই লক্ষ্য তা হলো একজন বড় শিল্পী হওয়া। শত কষ্টের মাঝে এটুকুই তার বেঁচে থাকার আশা।
‘অন্যরা কেউ আমার অন্তরের কষ্ট বুঝেনা। আমার জীবনে অনেক ব্যাথা। আমার মা-বাবা থাকতেও নাই। দুটি সন্তান থাকতেও নাই। জায়গা জমি কিছুই নাই। যেনো প্রশ্ন করতেই প্যান্ডোরার বাক্স হতে বের হতে থাকে একে একে কষ্টের কথা।
‘যদি আমি মইরা যাই তাইলে আমার সন্তান দুইটারে কে দেখবে? এই বুঝও আসে। আমারে কিসের সাথে কি খাওয়ায় দিছে। আমার মাও আমার সাথে কানতে কানতে ফকির হইয়্যা গ্যাছে। এখন ওরা কেউ আমারে ভালবাসে না।’
ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের চর হাজিগঞ্জের নদী ভাঙনকবলিত এলাকার ইয়াকু্ব মন্ডলের তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় এই আঙুরি। বাবা ইয়াকু্ব মন্ডল গাজির গান করে বেড়াতেন। তাই ছোটবেলা হতে গানের সুর তার রক্তে মিশে গিয়েছিল। অবশ্য তার বাবা তাদের ছেড়ে আবার বিয়ে করে আলাদা ঘর সংসার শুরু করেছে।
সাথী সরকার বলেন, ‘আমার বাবা একজন পাগল মানুষ। উনিও গাজির গান করতো। আরেকটা বিয়ে করে এখন থাকেন উনার মতো। আমাদের দেখেননা উনি। তবে আমার আব্বু খুব ভালো। এখন উনার কোন জ্ঞান নাই। আমার আব্বুর কথা আমি ভালো বলতে পারিনা। আমার মা বলতে পারেন।’ তার মায়ের নাম জরিনা বেগম যিনি স্বামী পরিত্যক্তা হিসেবেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। অভাবের সংসারে প্রাথমিকের পড়াশুনা শেষ করতে পারেনি সে। ছোটবেলা হতে জীবন কেটেছে গার্মেন্টসের শ্রমিকের কাজ করে। মাত্র ১১ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর গ্রামের জাকির হোসেনের সাথে। পেশায় রিকশা চালক জাকির গাঁজা মদ খেতো এবং গার্মেন্টস থেকে ফেরার পর আঙুরির সব উপার্জন কেড়ে নিতো বলে তার অভিযোগ।
আঙুরির ভাষায়, ‘সে আমারে অনেক কষ্ট দিছে। শুনছি আরেকটা বিয়ে হইছে। একটা ছেলে হইছে। আমার দুইটা ছেলেও ওদের কাছে। আমারে দেখতে দেয়না। দেখতে গেলে মারাধুরা করে।’ আঙুরি বলেন, ‘যখন গার্মেন্টসে ছিলাম মেশিন চালাইতাম আর গুনগুন করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার গান ভালো লাগে। আমার মনের বাঞ্ছা যে আমি বড় একজন শিল্পী হবো। তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর যাবত আমি গানের জগতে। ছোটবেলা হতে গানই ভালো লাগে। ১০/১২ বছর যাবত শিল্পী হিসেবে গান করছি।
কিভাবে গানের দীক্ষা নিলেন? এর জবাবে তিনি বলেন, দাদু ভাই রশীদ সরকার উনি যখন মারা গেলেন; আমি বিরাট একটা ব্যাথা পাইলাম। আমি তখন ঢাকার খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ায় রাস্তার পাশে পিঠা বেঁচতাম দুই টাকা করে। আমি নিজে খাইতাম নাম। ওই টাকা দিয়ে আমি ঘর ভাড়া দিতাম আর সংসার চলতো। আর তখন থেকেই এই গান বাজনা শিখছি। খুব কষ্ট করতাম তখন। আমার উস্তাদ আছে একজন উনাকে সবাই ‘বড় মিয়া’ বলে। তার কাছেই গানবাজনা শিখতাম। তারপরে আমার উস্তাদ হলো আলেয়া বেগম আলো। উনার বাড়ি শিবচর। উনি এখন মুরুব্বি হয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। বলছে সাথী তুমি আমার নাম নিয়ে নিয়ে গান করো। এভাবে এখন নিজেই গানের বায়না ধরি।
এখন কিভাবে চলছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি টুকটাক কাজ করি। ঘরের মধ্যে দর্জির কাজ করি। একটা দোকান দিছে। আমার জীবনের লক্ষ্য হলো আমি বড় একজন শিল্পী হবো।’
সাথী সরকারের বয়স এখন প্রায় ৪১। জীবনের এই মধ্য বয়সে এসে একটি ঘর হলেও সংসার আর হয়নি তার। এখন তার সংকল্প তিনি গানের শিল্পী হবেন। বড় বড় স্থানে গান গাইবেন।বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারী) সকালে সাংবাদিকররা যখন সাথী সরকারের ঘরে যান তখন তিনি সবেমাত্র একটি অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরেছেন। হাতে টুথব্রাশ। বললেন, সারারাত গান করেছি। এক হাজার টাকা পেয়েছি। আর কিছু বখশিশ। বলেন, গান ভালোবাসি তাই গান গেয়েই বাকি জীবন কাটাতে চাই। আমি একজন বড় শিল্পী হতে চাই। এজন্য সকলের দোয়া চাই।
Leave a Reply