অব্যাহত বাড়তি দামের লাগাম টানতে নানা পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এবার ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলার ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের এ উদ্যোগ কতটা কাজে আসবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু ভ্যাট প্রত্যাহারের সুযোগ দিলেই হবে না। একই সঙ্গে কঠোর বাজার মনিটরিং ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। কারণ যুদ্ধের অজুহাতে পর্যাপ্ত পণ্য থাকার পরও একটি চক্র তা গুদামজাত করে দ্রব্যমূল্য বাড়াচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের এমন উদ্যোগে বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তবে তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন তিনি। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যেসব পণ্যের ভ্যাট কমানোর কথা বলছে, এসব পণ্য তো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগেই দেশে আমদানি করা হয়েছে। যুদ্ধের অজুহাতে দাম বাড়ানো মানেই এখানে এক ধরনের কারসাজি করা হচ্ছে। কাজেই ভ্যাট কমালে খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।
তিনি বলেন, এসব সুবিধা ব্যবসায়ীরা যতই পাচ্ছে, ততই সুবিধা চাচ্ছে। সরকার যদি তাদের একের পর এক সুবিধা দিতেই থাকে, তাহলে সব পণ্যের দাম এক এক করে বাড়িয়ে দেবে। তাহলে সরকার কি সব পণ্যের ভ্যাট কমিয়ে দেবে, এমন পাল্টা প্রশ্ন রাখেন তিনি। তবে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের মতে, শুধু ভ্যাট কমালেই হবে না, কারণ ভ্যাট প্রত্যাহারে সরকার তো রাজস্ব হারাবে। সরকারকে এ বিষয়ে কঠোরভাবে মনিটরিংও করতে হবে। ভোরের কাগজকে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, গুটিকয়েক বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের বাজার জিম্মি রয়েছে। দেশে প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকায় বারবার এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ভ্যাট কমালে তাত্ত্বিকভাবে বাজারে এর প্রভাব পড়া উচিত। তাত্ত্বিকভাবে বলছি কারণ, আমরা যখন বাজারে গিয়ে একটি পণ্য কিনছি, তার আনুমানিক মূল্য ৮৫ টাকা, আর ১৫ টাকা ভ্যাট দিলাম। সরকারের ভ্যাট প্রত্যাহারের পর একজন সচেতন ভোক্তা বাজারে গিয়ে একই পণ্য কিনতে অবশ্যই বিষয়টি খেয়াল রাখবে। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্লিপ নিই না এবং সেই সুযোগটাই ব্যবসায়ীরা কাজে লাগায়। কাজেই সহজ উত্তর হচ্ছে, শুধু ভ্যাট কমালেই হবে না, এর মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
বাজার কারসাজির বিষয়ে তিনি বলেন, গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের দখলে বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। এজন্য বাজারে যখন পণ্যের দাম বাড়তে থাকে, তখন নতুন ব্যবসায়ীরা বাজারে ঢুকে যদি দ্রুত এর সুফল নিতে পারত, কোনো রকম বাধার সম্মুখীন হতে না হতো, তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বাজারে বুদবুদ সৃষ্টি হয়, কিন্তু আমরা কয়েক বছর ধরে দেখছি প্রতি বছরই একই ধরনের বুদবুদ বারবার হয়। প্রতিযোগিতামূলক বাজার থাকলে এমনটি হতো না। নানা জটিলতায় একজন নতুন ব্যবসায়ী সহজে বাজারে ঢুকতে পারেন না। শুধু ট্রেড লাইসেন্স করতেই তার কয়েক মাস লেগে যায়। সুতরাং যে গুটিকয়েক ব্যক্তি আছেন, তাদের জন্য তো সুরক্ষিত হয়ে আছে। সে কারণে দাম বাড়লে যে সরবরাহ বাড়বে, তা কিন্তু হচ্ছে না। তাই শাস্তি দিয়ে বা মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ভোক্তার কোনো উপকার হয় না, উপকার হয় নজরদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের। এজন্য প্রতিযোগিতাটাই প্রধান। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে বাজার অনেকটা স্বাভাবিক হতো।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআরকে। সর্বশেষ গত সোমবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এক সভায় তিন মাসের জন্য ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানায়। আর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভোজ্যতেল আমদানি, ক্রয় ও বিক্রিতে পাকা রসিদ লাগবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতও অভিযান শুরু করেছে।
বর্তমানে ভোজ্যতেলের আমদানি মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এরপর স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রির সময়ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে, এ থেকে আমদানিতে দেয়া ভ্যাট সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। তবে আমদানিনির্ভর ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাওয়ায় এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভ্যাটের পরিমাণও বাড়তে থাকে, যা ভোক্তা পর্যায়ে আরো চাপ তৈরি করে। দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরেই ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট কমানোর দাবি আসতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে। ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে থাকে ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশের বেশি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভ্যাট কমানো সমাধান নয়। বাজার মনিটরিং উত্তম। সরকার যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে মনিটরিংয়ের, সেটা আরো জোরদার করতে হবে। আমদানির জন্য বেসরকারি খাতকেও উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে এই যুদ্ধের সময়ও বাজারে কিছুটা পণ্যমূল্য বাড়লেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি বলেন, দেশে সাড়ে তিন কোটি পরিবার আছে। এর মধ্যে যদি এক কোটি পরিবার কম দামে টিসিবির পণ্য পায়, তাতে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসবে। তবে মানুষের হাতে অর্থ প্রবাহ বাড়াতে হবে। করোনার সময়ে প্রধানমন্ত্রী নি¤œবিত্ত পরিবারকে যে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছেন, সেভাবে আবার প্রণোদনা দেয়া দরকার। আর টিসিবির পণ্য বিক্রিতে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলার পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এটা সারা বছর চললে ভালো হয় বলে মনে করেন তিনি।
ক্রয় কমিটির সভায় টিসিবির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোট ৬৯১ কোটি টাকার চিনি, সয়াবিন তেল, ছোলা ও মসুর ডাল কেনার অনুমোদন দেয়া হয়। যা এক কোটি পরিবারের কাছে স্বল্পমূল্যে তুলে দেবে সংস্থাটি। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার থেকে কিনে যে সহযোগিতা করা দরকার, সেটা পূর্ণ মাত্রায় করা হয়েছে। পাশাপাশি টিসিবি আমাদের সব সময় লাগে না, এসব প্রয়োজনগুলো সারা বছর লাগে না, মাঝে মাঝে দেখা যায়। তখন সরকারকে ফ্লেক্সিবল থাকতে হয়। কারণ যখন যেটা প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সেটার জন্য ব্যবস্থা করতে হয়। তাই বলতে পারি, সরকারের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, তা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টিসিবি করেছিলেন মানুষের কষ্ট যাতে লাঘব হয়। আপনারা জানেন পৃথিবীতে জিনিসপত্রের অভাবে কোনো বিপদ ঘটে না। বিপদ ঘটে তখন, যখন বণ্টন পর্যায়ে ব্যত্যয় ঘটে। সময় মতো যদি বণ্টন করা না যায়, তখন আমাদের গুদামে মজুত থাকলেও কোনো লাভ হয় না। এজন্য আমরা মনে করি টিসিবির ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই টিসিবির কার্যক্রম স¤প্রসারণ করা হয়েছে, বণ্টন ব্যবস্থাও আরো বাড়াচ্ছি। প্রতিটা ইউনিয়ন পর্যায়ে টিসিবি নিয়ে যাব। যাতে কোনো গরিব মানুষ কষ্ট না পায়।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, আমরা এক কোটি পরিবারকে টিসিবির আওতায় নিয়ে আসতে যাচ্ছি। সেখানে ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে অন্যান্য যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে, সেসব জিনিস আমরা টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে তাদের কাছ পৌঁছে দেব।
Leave a Reply