
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হয় গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প-২। ইতোমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের এক লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি ঘর দেওয়া হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় এবার তৃতীয় ধাপে মজবুত করে প্রস্তুত হচ্ছে আরো ৬৫ হাজার নতুন ঘর। এর মধ্য থেকে আগামী ঈদের আগেই অর্থাৎ আগামী ২৬ এপ্রিল প্রায় ৩৩ হাজার পরিবার পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর।
ওইদিন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে জমির দলিলসহ ঘরের চাবি হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তুলনায় তৃতীয় ধাপে কাঠামোতে আসছে বেশ পরিবর্তন। বাড়ানো হয়েছে ব্যয়। যে কারণে ঘরগুলো মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। ঈদের আগে সেমিপাকা এসব ঘর ভূমিহীন-গৃহহীনদের ঈদ আনন্দে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস জানান, দেশের সব নাগরিকের আবাসন নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার। প্রথম ধাপে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জমিসহ ঘর করে দিচ্ছে সরকার। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘর দেওয়া শেষ। তৃতীয় ধাপে ৬৫ হাজার অসহায় পরিবারকে জমি ও ঘর দেবে সরকার। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সে আগামী ২৬ এপ্রিল ৩২ হাজার ৯০৪টি পরিবারকে জমি ও ঘর প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। একসঙ্গে এতো মানুষকে বিনামূল্যে বাড়ি-ঘর দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে নজিরবিহীন মন্তব্য করে আহমদ কায়কাউস বলেন, বিভিন্ন দেশে ভূমিহীন, গৃহহীনদের ঘর-বাড়ি নির্মাণের জন্য সুদবিহীন ঋণ দেওয়ার নজির থাকলেও ভূমিহীন-গৃহহীনদের ডেকে তাদের বিনামূল্যে বাড়ি-ঘর দেওয়ার নজির আর নেই।
জানা গেছে, তৃতীয় ধাপে ৬৫ হাজারের বেশি পরিবার পাবেন প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। এমন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়েই নির্মাণ কাজ করছে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প। এরই মধ্যে অর্ধেক বাড়ি প্রস্তুত হয়ে গেছে। ২৬ এপ্রিল এগুলো গৃহহীন ও ভূমিহীনদের মাঝে হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে এই ঘরগুলো সংশ্লিষ্ট পরিবারের জন্য ঈদের উপহার বলছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, তৃতীয় ধাপে ৬৫ হাজারের বেশি ঘর ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে হস্তান্তরের পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সে লক্ষ্যেই নির্মাণকাজ চলছে। এরই মধ্যে ৩২ হাজার ৯০৪টি ঘর নির্মাণ হয়ে গেছে। এগুলো ঈদের আগে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের মাঝে হস্তান্তর করা গেলে তাদের ঈদ আনন্দে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। ২৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তুলনায় তৃতীয় ধাপে কাঠামোতে আসছে বেশ পরিবর্তন। বাড়ানো হয়েছে ব্যয়। যে কারণে ঘরগুলো মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে এক লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি ঘর দেওয়া হয়েছে। দুই শতাংশ জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে তাদের। এর সঙ্গে রান্নাঘর ও টয়লেট ছিল। আঙিনায় হাঁস-মুরগি পালন ও শাক-সবজি চাষেরও জায়গা ছিল। তবে এসব ঘরে এর মধ্যে বেশকিছু ত্রুটি পেয়েছে সরকার। কোথাও দেয়াল ফেটে যাওয়া, ধস বা মাটি দেবে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। যেসব কারণে ত্রুটি হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে তৃতীয় ধাপে সমাধান করেই নির্মাণ করা হচ্ছে ঘর। যার কারণে ব্যয়ও বেড়েছে আগের তুলনায় ৬৯ হাজার টাকা।
জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রথমে দুর্যোগসহনীয় বাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। লক্ষ্য ছিল, প্রতিটি গ্রামের একজন করে মোট ৬৮ হাজার ৩৮টি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের কর্মকর্তাদের নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় এক বৈঠকে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করে। ঠিক হয়, দেশের সব গৃহহীন ও ভূমিহীন (ছয় লাখ আট হাজার ৫১৪টি) পরিবারকে সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এরপর ঘর নির্মাণে নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত কারিগরি কমিটি নকশা, এস্টিমেট ও ডিজাইন তৈরি করে। দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার খাতিরেই ইউএনওকে এ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেখভালে থাকবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বলা হয়, খাসজমিতে তৈরি হবে ঘরগুলো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে কাজ। দৃষ্টিনন্দন রঙিন টিনের দুই কামরার সেমিপাকা বাড়ি হবে। ঘরের আয়তন হবে দৈর্ঘ্যে ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি আর প্রস্থে ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। রান্নাঘর ও শৌচাগার থাকবে। প্রতি ১০ ঘরের জন্য একটি নলকূপ। সব মিলিয়ে বাড়িপ্রতি খরচ এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। ইটের সংখ্যা, সিমেন্ট ও বালুর পরিমাণও বলে দেওয়া হয় নকশা মোতাবেক। নির্দেশিকা অনুসারে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
ইউএনও ছাড়া এই বাস্তবায়ন কমিটিতে আছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি), ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। যথেষ্ট ছিল না বলেই তিন দফায় খরচ পুনর্নির্ধারণ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্ধারিত এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে এসে হয়েছে দুই লাখ টাকা। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন জানান, সারা বাংলাদেশে ঘরও নেই, জমিও নেই এমন পরিবারের সংখ্যা দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১। ভিটেমাটি আছে, ঘর জরাজীর্ণ কিংবা ঘর নেই এমন পরিবারের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ২৬১। গৃহনির্মাণের মাধ্যমে পুনর্বাসন করতে সারা বাংলাদেশে সব মিলিয়ে আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারকে তালিকাভুক্ত করেছে সরকার। দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন অসহায় মানুষদের মধ্যে যাদের ভূমি নেই, তাদের সরকারের খাস জমি থেকে দুই শতাংশ ভিটে এবং ঘর দিচ্ছে সরকার। যাদের ভিটে আছে ঘর নেই, তাদের ঘর দিচ্ছে সরকার। প্রতিটি ঘর দুই কক্ষ বিশিষ্ট। এতে দু’টি করে কক্ষ ছাড়াও সামনে একটি বারান্দা, একটি টয়লেট, একটি রান্নাঘর এবং কিছুটা খোলা জায়গা থাকবে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো- ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয় বাড়ে এমন কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ।
জানা গেছে, আগের দুই পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতায় মুজিববর্ষের উপহারের এসব ঘরকে অধিকতর টেকসই করতে নকশায় আনা হয়েছে পরিবর্তন। জমি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নেওয়া হচ্ছে বিশেষ সতর্কতা। নতুন একক গৃহ নির্মাণের ব্যয় বরাদ্দও বেড়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে প্রতিটি ঘরের নির্মাণ খরচ দুই লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের দুই পর্যায়ে প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে এক লাখ ৯৫ হাজার টাকা। তবে এসব ঘর নির্মাণকে ট্যাক্স ও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার ফলে বাজারদরের চেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে ঘরগুলো নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। রঙিন টিনশেডের প্রতিটি একক গৃহে ইটের দেয়াল, কংক্রিটের মেঝে এবং টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি দুটি করে শোয়ার ঘর, একটি রান্নাঘর, টয়লেট এবং সামনে খোলা বারান্দা রয়েছে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, একসঙ্গে এত মানুষকে বিনামূল্যে বাড়ি-ঘর দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ও সর্ববৃহৎ। বিশ্বে এটা নতুন মডেল, আগে কখনো কেউ যেটা ভাবেনি। আশ্রয়ণ প্রকল্পে সেই কথাই যেন সকলের মুখে। তিনি বললেন, অন্যের বাড়িতে থাকার অনেক সমস্যা। এখন নিজের বাড়িতে থাকবে তারা, এটা সত্যিই আনন্দের। বছরের পর বছর মানুষের জমিতে কাজ করা মানুষগুলো এখন কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।
Leave a Reply