২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন বাঙালি জাতির স্বপ্নের স্থাপনা পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু চালু হলে আশপাশের জেলাগুলো আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপরাপর জেলাসমূহ কতভাবে কত দিক থেকে প্রভাবিত হবে তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। সেখানকার কৃষির উন্নয়ন হবে, শিল্পের উন্নয়ন হবে, শিক্ষার উন্নয়ন হবে, হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান।
এসবের বাইরেও ওই অঞ্চলের জন্য অনেক সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে পদ্মা সেতু। একটি ভালো সম্ভাবনার বিষয়ে চলছে বেশ আলাপ, সেটি হলো পর্যটন। সেতুকে ঘিরে পর্যটনের ভালো সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য পছন্দের স্পটে পরিণত হতে পারে স্বয়ং পদ্মা সেতু; একইসঙ্গে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের সব পর্যটন স্পট জনপ্রিয় হবে আগের চেয়ে।
পদ্মার দুই পাড় মাওয়া-জাজিরায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্বপ্নের এই সেতু চালুর আগেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য মানুষ। সেতুর আশপাশে নৌ-যানে চড়ে কাছ থেকে দেখছেন স্বপ্নের সেতু। স্মৃতি হিসেবে সেতুর সাথে ছবি তুলতে দেখা গেছে অনেককে। পদ্মা পাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য আকৃষ্ট করছে সব বয়সের মানুষকে।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দেখতে এসেছেন ব্যবসায়ী ফরহাদ আহমেদ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু অনেক আলোচিত এবং সরকারের মেগা প্রজেক্ট। দৃষ্টিনন্দন এই সেতু দেখার আগ্রহ ছিল অনেক। তাই উদ্বোধনের আগে একবার দেখতে এলাম।
তিনি বলেন, সেতু কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। দারুণ অনুভূতি, যে কাউকে এ দৃশ্য মুগ্ধ করবে- পদ্মার বুক চিরে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন সেতু। এটি যেন নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ আমাদের এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য।
ইতোমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে সেতুর দুই পাড়। শরীয়তপুর প্রান্তের জাজিরায় গড়ে উঠছে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠান।
মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তেও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু পর্যটন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আপাতত ট্রলার ভাড়া দিয়ে পর্যটন-সুবিধা উপভোগ করছেন স্থানীয়রা। আগামীতে এখানে গড়ে উঠবে পরিকল্পিত পর্যটন এলাকা।
শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা থেকে শিবচরের মাদবর চর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সাড়ে ১০ কিলোমিটার নদী শাসন এলাকাও এখন দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র। প্রতিদিন বহু মানুষ ওই এলাকা ঘুরে দেখেন।
স্থানীয়রা জানান, কেবল নতুন করে গড়ে ওঠা পর্যটন কেন্দ্র নয়, পুরোনো দর্শনীয় স্থানগুলোও পদ্মা সেতুকে ঘিরে আরও জমজমাট হবে। শরীয়তপুরের নড়িয়ায় যেমন আছে রামঠাকুরের আশ্রম। এছাড়া ভেদরগঞ্জে মহিসার দ্বিগম্বরের দীঘি, হাটুরিয়া জমিদারবাড়ি, গীতিকার অতুল প্রসাদ সেনের বাড়ি, মানসিংহের দুর্গসহ নানা দর্শনীয় স্থাপনা এখানে রয়েছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এসব স্থানে পর্যটকদের আগমন আরও বাড়বে। এছাড়া যোগাযোগ সহজ হওয়ার ফলে সুন্দরবন, বাগেরহাট ও কুয়াকাটায় আগের চেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম হবে।
মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে রূপসী বাংলা হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর মালিক শিমুল খাঁন , পদ্মা সেতু দেখতে এখনই অনেকে আসছেন। সেতু চালু হওয়ার পরও এখানে অনেক পর্যটক আসবেন। সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে অনেকেই নতুন নতুন উপায়ে ব্যবসার চিন্তাভাবনা করছেন।
জাজিরার নাওডোবায় 'ফুড এক্সপ্রেস' নামে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ গড়ে তুলেছেন মো. তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এটি একেবারেই পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা। আগামী ২৫ জুন আমাদের স্বপ্নের এই সেতুর উদ্বোধন হবে। সে উপলক্ষে রেস্তোরাঁকে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে, জাঁকজমক আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যেহেতু এখানে অনেক পর্যটকের আনাগোনা হবে। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি ২৫ তারিখের পর আমাদের ব্যবসায়ে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ১নং সংযোগ সেতুর পাশে 'রোজ ভিউ' নামে প্রকৃতিবান্ধব একটি রেস্তোরাঁ গড়ে তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হাসান বিন ইসলাম সজিব। পর্যটকদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আশপাশে আরো রেস্তোরাঁ ও রিসোর্ট গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে তার।
তিনি বলেন, আমি ট্যুরিজমে পড়েছি, আমি জানি এখানে পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার দারুণ সম্ভাবনা আছে। একটি রেস্তোরাঁ ইতোমধ্যে চালু করেছি, ভালো সাড়া পাচ্ছি। আগামীতে সুন্দর একটি রিসোর্ট করার পরিকল্পনা আছে।
জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার বলেন, জাজিরা একটা অবহেলিত এলাকা ছিল। সেতু চালু হলে ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ হবে। তখন আর এই এলাকা অবহেলিত থাকবে না। এখানে পর্যটন কেন্দ্র, ইপিজেডসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা হবে; পার্ক, রেস্টুরেন্ট, হোটেল-মোটেল হবে।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান বলেন, এ অঞ্চলে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাজে লাগিয়ে পর্যটনের বিস্তার ঘটাতে চাই আমরা। সেজন্য সরকারের তরফ থেকে আমাদের প্রশাসন সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সন্তোষ কুমার দেব বলেন, বাংলাদেশে যে তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ (বিশ্ব ঐতিহ্য) রয়েছে তার দুটিই দক্ষিণাঞ্চলে- ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন। এই জায়গাগুলো মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এতদিন পর্যটকের সংখ্যা কম ছিল।
তিনি বলেন, এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় আরো অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোতে পর্যটকরা যেতে আগ্রহ দেখাবে এবং পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন পর্যটন স্পট তৈরি হবে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত ওই অঞ্চলের মানুষেরা উপকৃত হবে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পিরোজপুর থেকে গুলিস্থান যেতে কতো সময় লাগবে? ভোরে রওনা দিয়ে অফিস আদালতের কাজ সেরে বাড়ি এসে রাতের খাবার খাওয়া যাবেতো? ঢাকা ও এর আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার বিকেলে রওনা হয়ে রাত ৭টা-৮টার মধ্যে বাড়ি এসে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারবেতো? অফিস আদালতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা রোববার ভোরে বাসে চেপে রাজধানীতে পৌঁছে সঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হতে আর বাঁধা থাকছে নাতো?
এসব আলোচনা ছাপিয়ে আরও যে সব বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- বাংলার আপেলখ্যাত পিরোজপুরের পেয়ারা ও আমড়া। এছাড়া পিরোজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের উৎপাদিত শাক-সবজি, মাছ, মুরগী, দুধ, ডিম এখন সরাসরি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।
পিরোজপুর অঞ্চলের পেয়ারার সুনাম রয়েছে দেশের সর্বত্র। দ্রুত পচনশীল কিন্তু স্বাদে-গন্ধে অদ্বিতীয় এ পেয়ারাটি শুধুমাত্র পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার একটি বিরাট এলাকা এবং তৎসংলগ্ন ঝালকাঠীর কিছু এলাকায় ব্যাপকভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে।
এতদিন পদ্মায় সেতু না থাকায় ফেরী পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকে এই পেয়ারাবাহী ট্রাকগুলোর অনেক পেয়ারা পচে অখাদ্য হয়ে যেতো। এ কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মূখীন হতে-হতে এক পর্যায়ে পিরোজপুরের এ পেয়ারা ক্রয়-বিক্রয় থেকে বিরত থাকতো। এর ফলে পেয়ারার বাজারে ধ্বস নেমে হাজার-হাজার পেয়ারা চাষী বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতির সম্মূখীন হয়ে নিঃস্ব হয়েছে।
এ পেয়ারা উৎপাদিত অঞ্চলগুলোতে এখন আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। মধ্য আষাঢ়ে পেয়ারা পাকা শুরু করলে চাষীরা এবার পেয়ারার ন্যায্য মূল্য পাবেন- ফলে তাদের সংসারে ফিরে আসবে স্বচ্ছলতা।
স্বরূপকাঠী উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার জানান- শুধু পেয়ারা চাষীরাই নয়, পেয়ারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাই এ বছর থেকে আর্থিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে। এ অঞ্চলের এই সুমিষ্ট পেয়ারা ছড়িয়ে পড়বে দেশের বড়-বড় শহর বন্দর অঞ্চলে। বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারা উৎপাদনের এ উপজেলার নামও সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে। স্বরূপকাঠী উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আদাবাড়ি গ্রামের নিত্যানন্দ সমদ্দার জানান- পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের অনেক পরিশ্রমে উৎপাদিত এ ফল বাগান বিক্রি করে আমরা লাভবান হতে পারবো।
স্বরূপকাঠীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোশারফ হোসেন আশা প্রকাশ করে বলেন- পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবার পর থেকেই এ অঞ্চলের ফলমূল, শাক-সবজি চাষীদের এবং ব্যবসায়ীদের জীবনে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হবে।
স্বরূপকাঠী উপজেলা কৃষি অফিসার চপল কৃষ্ণ নাথ জানান, এ অঞ্চলে ৬৫০ হেক্টরে ৬ হাজার ৫০০ টন সু-স্বাদু পেয়ারা এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে এবং পেয়ারা চাষীরা লোকসান কাটিয়ে উঠে লাভের মুখ দেখতে পাড়বে।
তিনি আরও জানান, স্বরূপকাঠী অঞ্চলে স্বাদ ও গন্ধের আরও একটি কৃষিপণ্য হচ্ছে ঘৃতকাঞ্চন জাতের বোম্বাই মরিচ। ৭০ হেক্টরেরও অধিক জমিতে ৪০০ টন বোম্বাই মরিচ উৎপাদিত হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা না আসায় মরিচ চাষীরা নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হতো। এখন থেকে বোম্বাই মরিচ চাষীরাও অনেক লাভবান হবে।
পিরোজপুরের সুস্বাদু আমড়ার ব্যাপক উৎপাদন হয়ে থাকে স্বরূপকাঠী ও কাউখালী উপজেলায়। এ বিষয় জানতে চাইলে স্বরূপকাঠীর উপজেলা কৃষি অফিসার জানান- শুধুমাত্র স্বরূপকাঠীতেই ১৬০ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ২০০ টন আমড়ার উৎপাদন হয়ে থাকে। এখন থেকে পচনশীল এ ফলটিও সরাসরি পদ্মা সেতু পেরিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং আমড়া চাষীরাও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।
<p>সম্পাদক: মো:রোকন উদ্দিন রুমন </p><p>লেখক: আবদুল্লাহ যায়েদ তানজিন </p><p>উপদেষ্টা: মো: মোশাররফ হোসেন </p><p>thedailypadma@gmail.com<br></p><p> বার্তা কার্যালয়: দক্ষিন কমলাপুর,ফরিদপুর সদর, ফরিদপুর। </p><p>মোবাইল:০১৭১১১৪৮৯৫১, ০১৯১১৩০৩২২৯ ইমেইল: thepadma24@gmail.com<br></p>
© স্বর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।