
আর মাত্র একদিন পর উদ্বোধন হচ্ছে পদ্মাসেতুর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্মারক এই সেতু নির্মাণের শুরুটা হয়েছিলো ১৯৯৮ সালে। ওই বছরই যমুনা নদীর ওপর তিন হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়। তখনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মাসেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। বলা যায়, এটাই দালিলিকভাবে পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম সূত্রপাত। এ হিসেবে স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণের যাত্রা প্রায় দুই যুগের। পদ্মাসেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই হয় দেশীয় অর্থায়নে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা জাইকা ২০০৪ সালে উপযোগিতা সমীক্ষা ও প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় আরেক দফা এ তৎপরতা শুরু হয়। সেইসময় সেতু নির্মাণে পরিচালিত সম্ভাব্যতা পরীক্ষা অনুযায়ী ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট এক দশমিক চার বিলিয়ন ডলার বা ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের কাজটি চূড়ান্ত করলেও নিয়োগ দিতে পারেনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ২২ দিনের মাথায় পদ্মাসেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে সেতু প্রকল্পে রেল চলাচলের সুবিধা ছিল না। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের নির্দেশনা দেন। এর মধ্যেই সরকার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হয়ে যায়। পরের বছর জানুয়ারিতে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে প্রথমবারের মতো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে সেতু বিভাগ। এর মধ্যে সেতুর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি অন্যতম। শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল পাঁচ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি করে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার করা হয়। প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নকশা করা হয়েছিল। পরে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে বেশি ভার বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন রেল সংযোগ যুক্ত করা হয়। কংক্রিটের বদলে ইস্পাত বা স্টিলের অবকাঠামো যুক্ত হয়। সেতু নির্মাণে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি গভীরতা ধরা হয়। বাড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ব্যয়ও।
পদ্মাসেতু প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। তারপরও বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে সরকার তাদের সব শর্ত মেনে যেতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন না করার বিষয়ে একেবারেই অনড় থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন, নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মাসেতু। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মাসেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা তখন গোটা বাংলাদেশকে এক নতুন পথ দেখায়। এরকম একটি মেগা প্রকল্প বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করবে- এ কথা তখনো দেশের মানুষের কল্পনাতেও আসেনি। প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদ তো বটেই, অর্থনীতিবিদদের অনেকেও তখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে পাত্তা দিতে চাননি। তবে সবার সব সমালোচনা উপেক্ষা করেই অনড় ছিলেন শেখ হাসিনা। নিজের অবস্থান থেকে একচুলও সরে আসেননি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ পরে মিথ্যা প্রমাণিত হলেও শেষ পর্যন্ত দেশের জনগণের টাকাতেই জনগণের এই প্রকল্প নির্মাণের মহাযজ্ঞ শুরু করেন তিনি।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মাসেতুর নির্মাণের মূল কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রমত্ত পদ্মাকে বাগে এনে একে একে নদীর বুকের বসতে থাকে পিলার। পিলারগুলো বসতে থাকার পাশাপাশি চলছিল স্প্যান তৈরির কাজ। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যানটি বসলে পদ্মার বুকে সড়কপথের প্রথম দেড়শ মিটার দৃশ্যমান হয়। এরপর দেখতে দেখতে তিনটি বছর ধরে মোট ৪২টি পিলার বসেছে, তাতে বসেছে ৪১টি স্প্যান। পদ্মাসেতুর সর্বশেষ স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) বসানো হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। পদ্মাসেতুর ১২ ও ১৩তম পিলারের ওপর ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে পদ্মার দুইপাড় যুক্ত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে বহুল আলোচিত পদ্মাসেতুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বড় কাজের সমাপ্তি হয়। পদ্মাসেতুতে প্রথম স্প্যান বসানোর পর বাকি ৪০টি স্প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস লাগে। আর কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর মাধ্যমে পদ্মাসেতু সড়কপথ দিয়ে যুক্ত হয় ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট। দুই হাজার ৯১৭টি কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া দিয়ে মূল সেতুর যানবাহনের পথ তৈরি করা হয়। প্রতিটি স্ল্যাব ২২ মিটার লম্বা এবং দুই মিটারের কিছু বেশি চওড়া। যান চলাচল উপযোগী করে তুলতে সেতুতে পিচঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর। পিচঢালাইয়ের কাজ শেষ হয় গত ২৯ এপ্রিল। এরপর গত ১৭ মে টোলের হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সেতু বিভাগ। টোল আদায় এবং সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর মধ্যে কেইসি পদ্মাসেতু প্রকল্পে তদারক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে, আর এমবিইসি মূল সেতু নির্মাণকাজের দায়িত্বে আছে। তাদের পাঁচ বছরের জন্য ৬৯৩ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পদ্মাসেতুতে ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর। মোট ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি, জাজিরা প্রান্তের উড়ালপথে (ভায়াডাক্ট) ৪৬টি, মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টে ৪১টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। গত ১৮ এপ্রিল এসব ল্যাম্পপোস্ট ও এর মধ্যে বাতি লাগানোর কাজ শেষ হয়। এরপর পুরো সেতুতে কেবল (তার) টানা হয়েছে। প্রথমবারের মতো সেতুতে পরীক্ষামূলক বাতি জ্বালানো হয় ৪ জুন। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এ সেতুর নামকরণ করেছে ‘পদ্মাসেতু’। গত ২৯ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক নামকরণের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। আর গত ২৪ মে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, পদ্মাসেতু ২৫ জুন উদ্বোধন করা হচ্ছে। আর ২৬ জুন থেকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত এ সেতু।
Leave a Reply