দেশে কভিড, ডেঙ্গু ও ‘চোখ ওঠা’ বা কনজাংকটিভাইটিস সংক্রমণ চলমান। হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে এসব রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন রোগের সঙ্গে পুরনো রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে এ পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা তাঁদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকাল মঙ্গলবারের তথ্য মতে, আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে চলতি বছরের সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী (৯০০) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে তিনজন। একই সময়ে দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৮৭ জন আর মারা গেছে ছয়জন।
এই প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংক্রমণ প্রতিরোধ সপ্তাহ (১৬-২২ অক্টোবর)। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সংক্রমণ প্রতিরোধই ভবিষ্যৎ : সংক্রমণ প্রতিরোধের ৫০ বছর’।
চলতি বছরের এপ্রিলে ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম এমন ১০ হাজার ভাইরাস রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই অশনাক্ত। যদিও বেশির ভাগ সময়ই এসব ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
এই গবেষণার গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বাড়লে বিভিন্ন ধরনের অন্তত ১৫ হাজার নতুন ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, সংক্রামক রোগের ৭০ শতাংশ আসে প্রাণী থেকে। দেখা গেছে, কোনো কোনো প্রাণী জীবাণু বহন করে, কিন্তু তারা আক্রান্ত হয় না। সেটি আবার অন্য প্রাণীতে যায়।
সেখান থেকে মানুষ আক্রান্ত হয়। কভিড-১৯ হলো এর বড় উদাহরণ। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পুরনো রোগ আবার মানুষের মধ্যে আসতে শুরু করেছে। এ ছাড়া আমরা পরিবেশকে বিনাশ করে ফেলছি। ফলে প্রাণীগুলো মানুষের খুব কাছাকাছি চলে আসছে। এর সঙ্গে গৃহপালিত পশুর সঙ্গে বন্য প্রাণীর লালন-পালন বেড়েছে। ফলে সংক্রামক রোগ দিন দিন বাড়ছে। ’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে সংক্রামক রোগের তালিকায় উল্লেখযোগ্য হলো ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়াসিস, ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এভিয়ান ফ্লু, নিপাহ, অ্যানথ্রাক্স, মার্স-কভ, জলাতঙ্ক, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, শ্বাসনালির সংক্রমণ, এইচআইভি, ভাইরাল হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, খাদ্যে বিষক্রিয়া, মেনিনজাইটিস, ইবোলা, জিকা ও চিকুনগুনিয়া। সর্বশেষ এই তালিকায় যুক্ত হয় কভিড-১৯ রোগ। এর বাইরেও আরো অনেক সংক্রামক রোগ রয়েছে।
ডেঙ্গু : দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। প্রতিবছরের জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোররে এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। গত ১২ বছরে এই রোগে মৃত্যু হয়েছে ৬৩০ জনের। সবচেয়ে বেশি রোগী আক্রান্ত হয় ২০১৯ সালে। ওই বছরে শনাক্ত হয় এক লাখের বেশি মানুষ। মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য মতে, চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ২৬ হাজার ৯৩৮ জন, আর মৃত্যু হয় ৯৯ জনের। দেশের ৫০টি জেলায় এ বছর ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারে।
সম্প্রতি আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, ২০১৭ সালে দেশে ডেন-ওয়ান ও ডেন-টু সেরোটাইপ ডেঙ্গুর উপস্থিতি ছিল। এরপর ২০২১ সালে ডেন-থ্রি ছিল। এবার ঢাকায় ডেন-ফোরের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে ডেন-ওয়ান, ডেন-থ্রি ও ডেন-ফোর সেরোটাইপ ডেঙ্গু হচ্ছে।
কভিড : ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয় ওই বছরের ১৮ মার্চ। গত প্রায় আড়াই বছরে কভিড শনাক্ত হয় ২০ লাখ ৩২ হাজার ৮৩২ জনের দেহে। এ রোগে মারা যায় ২৯ হাজার ৪০২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারা অমিক্রনের বিএ.৪ ও বিএ.৫ উপধরনটি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। তবে করোনা এখন আর আগের মতো নেই। দেশের অধিকসংখ্যক মানুষ টিকা নিয়েছে। ফলে টিকা সুরক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা এবং এর হার দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুরা বাকি ছিল, তারা টিকার আওতায় চলে আসছে। ফলে হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যাও কমেছে।
‘চোখ ওঠা’ : সাধারণত বর্ষার শেষে শীতের আগমুহূর্তে ‘চোখ ওঠা’ বা কনজাংকটিভা রোগের মৌসুম। কারণ ভাইরাস ছড়ানোর জন্য প্রকৃতিতে যে তাপমাত্রা প্রয়োজন এটি হলো তার উপযোগী সময়।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্নিয়া বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাদের বলেন, চোখ ওঠা হলো একটি ভাইরাসজনিত রোগ। চোখ জ্বলা, চুলকানি, খচখচে ভাব থাকা, চোখ থেকে পানি পড়া, চোখে বারবার সাদা ময়লা আসা, কিছু ক্ষেত্রে চোখে তীব্র ব্যথা এ রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাদের বলেন, পরিবারের কারো চোখ উঠলে তিনি যেন কিছুদিন আলাদা থাকেন। রোগীর ব্যবহার্য রুমাল, তোয়ালে, বালিশ, বা তাঁর ব্যবহার করা কাপড় অন্যরা ব্যবহার না করে সতর্ক থাকতে হবে।
Leave a Reply