শারদীয় দুর্গোৎসবের পরপরই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শ্যামাপূজা আজ সোমবার। এটি কালীপূজা ও শুভ দীপাবলি উৎসব হিসেবে পালন করেন অনেকেই।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে, শ্যামা দেবী হলেন শান্তি, সংহতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের প্রতীক। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ভক্তদের জীবনে অবারিত কল্যাণের অঙ্গীকার নিয়ে পৃথিবীতে শ্যামা মায়ের আগমন ঘটে।
কালীপূজার দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সন্ধ্যায় বাড়িতে ও শ্মশানে প্রদীপ, মোম প্রজ্বালন করে স্বর্গীয় বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনকে স্মরণ করবেন। অমাবস্যার সব অমানিশা দূর করতে দীপাবলির এ রাতে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রতিবছরের কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে শ্যামাপূজা বা কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিন ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, সূত্রাপুরসহ অনেক এলাকায় বেশ ঘটা করে শ্যামাপূজা হয়। রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে পূজার আয়োজন রয়েছে। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে কেন্দ্রীয়ভাবে শ্যামাপূজা হবে।
কালীপূজার ইতিহাস
সনাতন ধর্মমতে কালী বা কালিকা হচ্ছেন শক্তির দেবী। কাল শব্দটির অর্থ সময় হতে পারে, আবার এটা রং ও বুঝাতে পারে কাল তথা কৃষ্ণবর্ণ, এর অর্থ হতে পারে মৃত্যুবোধক। যেমন আমরা বলি- ‘কাল’এসে গেছে, মৃত্যুর সময় সমাসন্ন, মহাকাল এসে গেছে। দেবীর নাম মহাকালীও বটে। কালীর নাম কাল না হয়ে কালী হলো এ কারণে যে শিবের অপর নাম কাল, যা অনন্ত সময়কাল বোধক। কালী হচ্ছে কাল এর স্ত্রীলিঙ্গ বোধক। মা কালী মা দুর্গা বা পার্বতী’র সংহারী রূপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষার বিখ্যাত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম এ বলা হচ্ছে ‘কাল শিবহ্। তস্য পত্নতি কালী।’ অর্থাৎ শিবই কাল বা কালবোধক। তাঁর পত্নী কালী। কালী হচ্ছেন মা দুর্গার বা পার্বতীর অপর ভয়াল রূপ। তিনি সময়ের, পরিবর্তনের, শক্তির, সংহারের দেবী। তিনি কৃষ্ণবর্ণা বা মেঘবর্ণা এবং ভয়ংকরা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভয়ংকরেরও পূজা করেন। তিনি অশুভ শক্তি’র বিনাশ করেন। তাঁর এই শক্তি’র পূজা সনাতন সমাজকে প্রভাবিত করেছে, বিশুদ্ধ শক্তি সঞ্চারিত করেছে, অন্তর শুদ্ধি দিয়েছে, দুর্দিনের দুর্বলতায় সাহস দিয়েছে। শাক্ত সৃষ্টিতত্ত্ব মতে এবং শাক্ত-তান্ত্রিক বিশ্বাস মতে তিনিই পরম ব্রহ্ম। কালীকে এই সংহারী রূপের পরেও আমরা মাতা সম্বোধন করি। তিনি সন্তানের কল্যাণ চান তিনি মঙ্গলময়ী, তিনি কল্যাণী এটাই তাঁর প্রতি সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল আস্থা ও নির্যাস।
কালীর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু তথা বাঙালিদের কাছে এই দেবী বিশেষভাবে শক্তির দেবী রূপে পূজিত হন। এছাড়াও বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। দশমহাবিদ্যার ইনি প্রথমা মহাবিদ্যা। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যেই দেবী কালীর পূজা করা হয়। দেবী কালীর অসংখ্য নামের মধ্যে দক্ষিণ, সিদ্ধ, গুন্য, ভদ্র, শ্মশান, রক্ষা ও মহাকালী। দেবী কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, দেবাসুরের যুদ্ধে পরাজিত দেবতাদের প্রার্থনায় আদ্যাশক্তি ভগবতি পার্বতীর দেহ কোষ থেকে দেবী কৌষিকী আবির্ভূত হন। তখন ভগবতি দেবী কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন বলে তাঁর নাম কালী বা কালিকা। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিনটি কাল নিয়ে মহাকাল। আর সেই মহাকালের শক্তি কালী। অনন্তকালে সৃষ্টি রূপিণী পরমা প্রকৃতির রূপ এই মহাকালী। যারা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করতে চান যারা তন্ত্র এবং মন্ত্র ক্ষমতায় যারা বিশ্বাস করেন, যারা মানুষরূপী হয়েও ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চান তারা মা কালী পূজা অত্যন্ত ভক্তি সহকারে করে থাকেন।
কালীপূজা বা শ্যামাপূজা হিন্দু দেবী কালীর পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত একটি হিন্দু উৎসব। প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই উৎসব উপলক্ষে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষিত হয়। বাংলায় গৃহে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীপ্রতিমার নিত্যপূজা হয়ে থাকে। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত সাংবাৎসরিক দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই দিন আলোকসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা রাত্রিব্যাপী কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, দীপান্বিতা কালীপূজার দিনটিতে ভারতের অন্যান্য জায়গায় দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই দিন লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হলেও বাঙালি, অসমীয়া ও ওড়িয়ারা এই দিন কালীপূজা করে থাকেন। এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ফলহারিণী কালীপূজাও যথেষ্ট জনপ্রিয়। ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে।
‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ’(পাণিনি ৪।১।৪২)। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত-এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে, তা দেবী দুর্গারই একটি রূপ (মহাভারত ৪।১৯৫)। মহাভারত-এ ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মা বহন করেন। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায় (হরিবংশ, ১১৫৫২)।‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে “সময়ের থেকে উচ্চতর”। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। প্রকৃত অর্থে কাল(সময়) কে কলন(রচনা) করেন যিনি তিনিই (কাল+ঈ) কালী।
কালী কেন শক্তির দেবী শক্তির দেবী হিসাবেই কালী পূজিত হন। সনাতন ধর্ম-মতে এর উল্লেখ মেলে। কালী-নাম মাহাত্ম্যে কাল-কে যদি আলাদা করে নেওয়া হয় তাহলে কাল-এর একাধিক অর্থ বের হয়। কাল মানে সময়, আবার কাল তথা কৃষ্ণবর্ণ। কাল-এর অর্থ-এ লুকিয়ে আছে সংহার- বা মৃত্যু ভাবনাতেও। কালীকে কাল
অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী বলা যেতে পারে, আবার পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী নিয়ন্ত্রক বলা হয়। এবং সেই কারণেই দেবীর নাম কাল যুক্ত ঈ-কালী। সনাতন ধর্মে ঈ-কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ-কে উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নিগুর্ণ ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করার জন্য। আবার শ্রীশ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ মেলে যে, ‘ইয়া দেবী সর্বভুতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে, নমস্তসৈ, নমস্তসৈ নমো নমোঃহ।’ এই কারণে অনেকেই কালী-কে ক্রোধাম্বিতা, রণরঙ্গিনী বা করালবদনা বলেও অভিহিত করে থাকেন। ‘কালী’ নাম কেন কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ হল কালী। আর শিব-কেও কাল নামে ডাকা হয়। কাল মানে অনন্ত সময়। এই সময়েরই স্ত্রীলিঙ্গ বোধক হচ্ছে কালী। শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে যে কাল সর্বজীবকে গ্রাস করে, সেই কালকে আবার যিনি গ্রাস করেন-তাঁকেও কালী বলা হয়। জগতের উৎপত্তি, স্থিতি, মহাপ্রলয়-এর পিছনে রয়েছে কালশক্তি। সবচেয়ে মজার কথা এই সবের জন্য যে মহাকাল পরিস্থিতির উদ্ভূত হয় তাই আবার সব সৃষ্টিকে গ্রাস করে। সনাতন ধর্মে উল্লেখ যে মহাকালেরও পরিণাম আছে। মহাপ্রলয়ের কালশক্তি মহাকালীর ভিতরেই নিঃশেষ লীন হয়ে যায়।
কালিকা পুরাণ থেকে জানা যায় পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই রাক্ষস ছিল এবং সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল । পৃথিবীতে চরম অত্যাচার শুরু করেছিলেন দুই রাক্ষস ভাতৃদ্বয়। তাদের আক্রমণে পৃথিবীর সকল মানুষ একপ্রকার চরম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারা তাদের আক্রমণের পরিধি শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি তাঁরা দেবলোকেও আক্রমণ করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে এবং দেবতাদের দেবলোক ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। এমন সময় দেবতারা ভগবান বিষ্ণু,মহাদেব শিব এবং প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন । তখন তাদের সম্মিলিত উপদেশ যেন সকল দেবতারা মিলে আদ্যশক্তি মহামায়ার উপাসনা করেন । ফলে দেব লোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেব লোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন। তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন। মা মহামায়া অবতীর্ণ হলে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তার রুদ্র রূপ ধারণ করেন। দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত দেবী কৌশিকী মা মহামায়া দেহ থেকে নিঃসৃত হলে মা মহামায়া কাল বর্ণ ধারণ করে যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়।
মা কালী বা মা করুণাময়ী, তার কাছে কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই। যিনি আকুল হয়ে ডাকবেন, তাকে রক্ষা করতে মা বার বার আবির্ভূত হবেন। তিনি দেবতা, রাক্ষস, দৈত্য বা মানুষ যিনিই হন। মা কালীকে অনেকেই অনেক কারণে ডেকে থাকেন, আর মা তার ভক্তদের দশ হাতে রক্ষা করেন। মাকে কেউ ডাকে আর্থিক উন্নতির জন্য, আবার কেউ ডাকেন সন্তানের জন্য, রোগ, শত্রু ও এই রকম নানা কারণে ভক্তরা মাকে ডেকে থাকেন।
তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তোড়লতন্ত্র অনুসারে, কালী আট প্রকার। যথা: দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। মহাকাল সংহিতার অনুস্মৃতিপ্রকরণে নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা: দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালিকা, সিদ্ধিকালী,সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা। অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ আছে। যথা: সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী। জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে কালীর যে রূপগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হল: ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালিকা, ধনদকালিকা, রমণীকালিকা, ঈশানকালিকা, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সপ্তার্নকালী। মুণ্ডকোপনিষদে মহাকালী স্বয়ং কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সধূম্রবর্ণা, বিশ্বরুচি, স্ফুলিঙ্গিনী, চঞ্চলজিহ্বা ইত্যাদি নামে ভূষিত হন। মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে পূজার নাম জৈষ্ঠ্যে ‘ফলহারিণী’ কালী পূজা।
হিন্দু ধর্মে সকল দেব দেবীর মধ্যে মা কালী হলেন নারীদের ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক তথা শক্তিরূপের অন্যতম সেরা প্রতীক। এই রূপ দিয়ে মা সমস্ত বিশ্বকে একদিকে যেমন বুঝিয়েছেন অসুরদের বিনাশ এর জন্য তিনি এই রূপ ধারণ করেছেন, তেমনই নারীরা তাদের মমতাময়ী রূপের খোলস ত্যাগ করে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সকল অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার শেষ করার ক্ষমতাও রাখে। মাতা কালী হলেন কৃষ্ণ বর্ণের বা শ্যামা বর্ণের ।তার যে রুদ্রমূর্তি আমরা দেখতে পাই তাতে দেখি তার দুই নেত্র ভয়ংকর রক্ত বর্ণের হয়ে থাকে। মাতা কালীর যে সকল মূর্তি ,চিত্র আমরা দেখতে পাই তাতে সবগুলিতেই আমরা দেখি মা কালী দাঁড়িয়ে আছেন ভগবান শিবের ওপর এবং তার জিভ সম্মুখে অগ্রস্থ অবস্থায় আছে। অনেকের মনেই এই প্রশ্ন দেখা যায় কেন মা কালী তার স্বামীর উপর এইরূপ জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন?
মা মহামায়া অবতীর্ণ হলে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তার রুদ্র রূপ ধারণ করেন। দেবতারা তখন এক প্রকার খুশি হন। কিন্তু অসুরেরা সম্মিলিত ভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। আর অসুরদের এরকম সম্মিলিত লড়াইয়ে মাতা মহামায়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং তার তৃতীয় নেত্র থেকে জন্ম নেয় এক অত্যন্ত রুদ্রমূর্তি এবং এই ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি হলো মা কালিকা বা মা কালী । যখন তিনি মা কালী রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন তখন সকল অসুরদের বিনাশ করতে শুরু করেন এবং এক প্রকার হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যান। অসুর হত্যা করে মা তাদের নরমুণ্ড হাতে ধরেন এবং নরমুণ্ডের মালা করে গলায় পরিধান করেন। এছাড়াও খড়্গের দ্বারা অসুরদের হাত কেটে তিনি তার পোশাক বানিয়ে পরিধান করে নেন নিম্নাঙ্গে। এইরকম অবস্থায় অসুরেরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তারা বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে এই দেবীর মোকাবিলা করবে?
তখন শুম্ভ-নিশুম্ভ তাদের সেনাপতি রক্তবীজকে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ করেন। এই ভয়ঙ্কর দেবীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসুরদের মধ্যে এক ভয়ংকর অসুর ছিল রক্তবীজ ।এই অসুর প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে পেয়েছিলেন এক অভিনব বর। বরটি ছিল এইরূপ, অসুর রক্তবীজকে যদি কেউ হত্যা করতে উদ্যত হন কোন অস্ত্র বা তলোয়ার দিয়ে এবং তার শরীর থেকে যদি বিন্দুমাত্রও রক্তপাত হয় তাহলে সেই রক্তের বিন্দুকনা যেখানে যেখানে পড়বে প্রতিটি বিন্দু কণা থেকেই এক একটি করে রক্তবীজের পুনরায় জন্ম হবে অর্থাৎ একপ্রকার নিজেকে অমর করার বর চেয়ে নিয়েছিলেন প্রজাপতির কাছে অত্যন্ত চালাক অসুর রক্তবীজ। এই রুপ বরশালী রক্তবীজকে দেখামাত্রই মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। খড়্গের আঘাতে রক্তবীজের শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করলে তার সারা শরীর থেকে রক্ত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং তখনই প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে সৃষ্টি হয় লক্ষ লক্ষ রক্তবীজ । এইভাবে মা প্রতিবার রক্তবীজকে মারতে উদ্যত হলে আরো লক্ষ লক্ষ নতুন রক্তবীজ জন্ম নেয় । তখন মা বুঝতে পারেন রক্তবীজের বরের কথা। তাই মা এইবার সকল রক্তবীজের রক্তকে তার মুখ দিয়ে পুরোটাই গ্রহণ করেন ,হত্যা করার পর ।এইভাবে তিনি রক্তবীজকে হত্যা করতে সফলতা লাভ করেন।
এরপরই শুরু হয় মায়ের তাণ্ডবনৃত্য । সেই তান্ডব নৃত্যে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপতে থাকে। দেবতারা যখন এই তান্ডব নিত্য দেখেন তখন তারা বুঝতে পারেন সারা পৃথিবী জুড়ে এক প্রলয়ের সৃষ্টি হতে চলেছে, যা তাদের পক্ষে রোধ করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। আর এই প্রলয় যে সকল কিছুকে ধ্বংস করে দেবে তা তারা উপলব্ধি করতে পারেন।
তখন তারা ছুটে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। তখন মহাদেব সকলের অনুরোধ শুনে মা কালীর রুদ্রমূর্তি তাণ্ডবনৃত্য বন্ধ করার জন্য মায়ের সামনে আপন দেহ শায়িত করেন । তাণ্ডব নৃত্য করতে করতে মা কালী যখন ভগবান শিবের বুকে পা দেন তখন এক প্রকার সম্বিৎ ফিরে পান। তখন দেখেন তিনি তার স্বামীর বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।আর তাই তখন হঠাৎ করে লজ্জায় তার জিভ সম্মুখে বেরিয়ে আসে ।আর এই সন্মুখে বেরিয়ে আসা মা কালীর রুদ্র মূর্তি আমরা প্রত্যক্ষ করি সকল রূপে এবং বিভিন্ন চিত্রকলায় ও বিভিন্ন মূর্তিতে। এই ভাবেই মায়ের চিরাচরিত সম্মুখ বের করা মূর্তি প্রসিদ্ধিলাভ করে এই পৃথিবীলোকে।
Leave a Reply