ইসরায়েলকে বরাবরই ‘অন্ধ সমর্থন’ দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। কুটনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক— সব বিষয়েই তেলআবিবের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত ওয়াশিংটনের সাহায্যের দ্বার। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কী হবে যদি কখনও ফাটল ধরে দু’দেশের সুসম্পর্কে? বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে কিছু সম্ভাবনা তুলে ধরেছে কাতার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের গুড বুক থেকে নাম মুছে গেলে, বড়সড় বিপদেই পড়বে ইসরায়েল।
সম্প্রতি, এফ-থার্টি ফাইভ আই যুদ্ধবিমানের সাহায্যেই ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। অত্যাধুনিক এই ফাইটার ইসরায়েলের চাহিদা অনুসারে বিশেষভাবে তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
আয়রন ডোম আর অ্যারোর মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির পেছনেও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রর অর্থায়ন। এছাড়া অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্র আর সামরিক গোয়েন্দা তথ্যসহ বিভিন্নভাবে মার্কিন সহায়তা পায় ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হলে এর সবই হারাবে দেশটি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, আমি মনে করি, মার্কিনদের সাহায়তা ছাড়া ইসরায়েলের জন্য পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কঠোর হয়ে উঠবে। দেশটির সামরিক সক্ষমতা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হয়তো, বড় বড় কোম্পানি থেকেও ছাঁটাই করা হতে পারে ইসরায়েলি কর্মীদের।
তিনি আরও বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আগামীকাল বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমার অনুমান, তারা সবাই অবিলম্বে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে, যদিও এক্ষেত্রে কেউ প্রথম হতে চাইবে না। আমি জানি না এটি কী রূপ নেবে, তা নিষেধাজ্ঞা হবে নাকি জাতিসংঘের সনদের সপ্তম অধ্যায় (অবিলম্বে হস্তক্ষেপের অনুমতি প্রদানকারী) কার্যকর করা হবে, তবে এটি দ্রুত হবে।’
শুধু সমরক্ষেত্রে নয়, মার্কিন সহায়তা ছাড়া আর্থিকভাবেও চাপে পড়বে দেশটি। কোটি কোটি ডলার মূল্যের মার্কিন সমরাস্ত্র, সামরিক সহায়তা হিসেবে অর্থাৎ প্রায় বিনামূল্যেই পায় ইসরায়েল। বন্ধুত্ব না থাকলে অনান্য রাষ্ট্র থেকে চড়া মূল্যে এসব সমরাস্ত্র কিনতে বাধ্য হবে তেলআবিব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের ওপর থেকে মার্কিন সুনজর সরে গেলে গাজা যুদ্ধ থেকেও সরে আসতে পারে দেশটি। নাজুক অর্থনীতি নিয়ে তখন আর যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা থাকবে না ইসরায়েলের। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের চাপ থেকে রক্ষাকর্তা হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন মিলবে না। ফলে, কুটনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ তেলআবিবের সাথে ছিন্ন করবে সম্পর্ক।
ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাহার হলে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে কী ঘটতে পারে, বিশেষ করে ইসরায়েল আক্রমণের শিকার হবে বলে যে দাবি করে, তার বাস্তবতা কতটুকু? রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট এবং সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের সিনিয়র ফেলো এইচ এ হ্যালিয়ার এই বিষয়ে তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন।
হ্যালিয়ার বলেন, আমার মনে হয়, আপনি যদি হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রকে সমীকরণ থেকে সরিয়ে দেন, তাহলে সেখানে একটি নিষ্পত্তির পথে সবচেয়ে বড় একক বাধাটি সরে যাবে।’ তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, ইসরায়েলের জন্য সত্যিকার অর্থে এই অঞ্চলে নিজেদেরকে সংহত করার বিষয়টি সবসময়ই দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের অগ্রাধিকার। কারণ, ‘মার্কিন সমর্থনই তাদের দায়মুক্তভাবে কাজ করার ক্ষমতা জোগায়, যেমনটা আমরা ফিলিস্তিনি, লেবানিজ এবং সিরীয়দের ক্ষেত্রে দেখেছি।
ইসরায়েল আক্রমণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তাকে নাকচ করে দিয়ে একটি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘সিরিয়ার সেনাবাহিনী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে ইসরায়েলে পাল্টা আক্রমণ থেকে বিরত থাকছে না। তারা আক্রমণ থেকে বিরত থাকছে কারণ তারা আরও যুদ্ধে আগ্রহী নয়, তারা জানে যে তাদের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে; অন্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।’
অন্যদিকে, ড্যানিয়েল লেভি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের গভীর প্রভাবের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমেরিকা সত্যিই ইসরায়েলের ডানপন্থীদের জন্য একধরনের উপহার।’
লেভি ব্যাখ্যা করেন, যদি কোনো ডেমোক্র্যাট ক্ষমতায় থাকেন, তাহলে ইসরায়েলিরা বলতে পারে: ‘দেখুন, আমরা তাদের (আমেরিকানদের) কত ভালোভাবে সামলাচ্ছি।’ আর যদি ট্রাম্পের মতো কেউ ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারা বলতে পারে: ‘দেখুন, আমরা নিশ্চয়ই কিছু ঠিক করছি: যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে একমত।’ এভাবে, উভয় ক্ষেত্রেই তারা বৈধতা অর্জন করে। যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে এই বৈধতার ভিত্তি আর থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সমর্থন প্রত্যাহার হলে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে কী ঘটবে? প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজে আত্তার এর মতে, এমনটা হলে ইসরায়েলের সামরিক অগ্রাধিকারগুলো আমূল বদলে যাবে এবং দেশটি উল্লেখযোগ্যভাবে আরও অরক্ষিত হয়ে পড়বে।
হামজে আত্তার বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র আগামীকাল অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে ইসরায়েল সম্ভবত প্রায় এক বছর গাজায় তার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। তবে, এর অগ্রাধিকারগুলো পাল্টে যাবে কারণ দেশটি উল্লেখযোগ্যভাবে আরও অরক্ষিত হয়ে পড়বে।’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইসরায়েল তখন সচেতন থাকবে যে গাজায় ব্যবহৃত প্রতিটি বুলেট বা বোমা তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য একটি কম হয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া ইসরায়েলের সামরিক দুর্বলতা আরও কয়েকটি দিক থেকে প্রকট হবে বলে মনে করেন আত্তার। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটগুলোর ব্লক করা বন্ধ হয়ে যাবে, যার উপর ইসরায়েল তার অঞ্চল লুকানোর জন্য নির্ভর করে। এতে তাদের প্রতিপক্ষরা অবিলম্বে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে নজর রাখতে পারবে।’ এছাড়াও, ইসরায়েল আইরন ডোম এবং অ্যারো সিস্টেমের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হারাবে, যা আংশিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। এর ফলে দেশটি আক্রমণের জন্য অনেক বেশি উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।
হামজে আত্তার আরও উল্লেখ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি মানে ইসরায়েলকে নতুন সামরিক সরবরাহকারী খুঁজতে হবে, সম্ভবত ইউরোপের ন্যাটো দেশগুলো থেকে, কারণ বেশিরভাগ সরঞ্জামই সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ তবে, এটি দ্রুত সম্ভব হবে না। কারণ, রাশিয়া থেকে হুমকির প্রেক্ষিতে ইউরোপের ইতিমধ্যেই অস্ত্রের ঘাটতি রয়েছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক যেকোনো চাপের মুখে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল বিরোধী যেকোনো আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে সর্বদা তেলাবিবের পাশে থেকেছে ওয়াশিংটন। যদি কখনও এ পথচলায় ছন্দপতন ঘটে— সেই রেশ কি একা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম ইসরায়েল? এমন প্রশ্ন ওঠা অবান্তর নয়।
Leave a Reply