
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। এর ফলে হু হু করে বাড়তে থাকা মার্কিন ডলার এখন উল্টো পথে হাঁটছে। খোলাবাজারে প্রতিদিনই কমছে ডলারের দাম; বিপরীতে বাড়ছে টাকার মান। গত সপ্তাহে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে নগদ ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। গত দুইদিন বুধ ও বৃহস্পতিবার ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১১ টাকায়। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলাবাজারে ডলারের দাম কমেছে ১০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের সুফল মিলছে ডলারের বাজারে।
এদিকে জুলাইয়ের পর চলতি আগস্টেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট ডলার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করছে। চলতি আগস্ট মাসের ১৬ দিনে ১১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দেশীয় মুদ্রায় (প্র?তি ডলার ৯৫ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ১১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা; যা গত বছরের আগস্টের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। গত বছরের ১ থেকে ১৬ আগস্ট ১০০ কোটি ৭০ লাখ ( এক দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি আগস্ট মাসে প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে সাত কোটি ২৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে। জুলাই মাসের পর আগস্টেও প্রবাসী আয়ের গতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরের প্রথম দেড় মাসে (১ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট) ৩২৮ কোটি ৮০ লাখ (তিন দশমিক ২৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময় (দেড় মাসে) হিসাবে বেশি এসেছে ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দেড় মাসে (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট) ২৮৭ কোটি ৮০ লাখ (দুই দশমিক ৮৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত ১৬ দিনের মতোই মাসের বাকি দিনগুলোতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। গত জুলাই মাসের মতো চলতি আগস্ট মাসেও দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে। গত জুলাই মাসে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (দুই দশমিক এক বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সের বিস্ময়কর উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি হবে নতুন রেকর্ড।
অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ার কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। এর ফলে মার্কিন ডলার এখন উল্টো পথে হাঁটছে। খোলাবাজারে প্রতিদিনই কমছে ডলারের দাম, বিপরীতে বাড়ছে টাকার মান। গত সপ্তাহে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে নগদ ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। গত দুই দিন বুধ ও বৃহস্পতিবার ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১১ টাকায়। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলাবাজারে ডলারের দাম কমেছে ১০ টাকা। রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও গুলশান এলাকার একাধিক মানি চেঞ্জারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা ১১০ টাকায় ডলার কিনে ১১২ টাকায় বিক্রি করছেন। অবশ্য আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানি বিল মেটাতে এই দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। নিয়ম অনুযায়ী, এটাই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর। তবে বা?ণি?জ্যিক ব্যাংকগু?লো?তেও এখন ১০৬ থে?কে ১০৮ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের সুফল মিলছে ডলারের বাজারে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহ থেকে আরো কমবে ডলারের চাহিদা। এতে খোলাবাজারে ডলারের দাম আরো কমে আসবে। দেশে ডলারের সংকট কাটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানিতে দেওয়া হয়েছে নানা শর্ত। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে দেওয়া হয়েছে নীতিগত ছাড়। এছাড়া ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ডলার কারসাজির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে চালাচ্ছে অভিযান। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। ছয় ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের অপসারণ সংক্রান্ত নির্দেশনার পর ওই ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর এমডিদের ১৭ আগস্ট বুধবার এ চিঠি দেওয়া হয়। এছাড়া ডলার বিক্রির অতিরিক্ত মুনাফা ব্যাংকের আয় খাতে নেওয়া যাবে না বলে সব ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। ওই ছয় ব্যাংক হলো- ডাচ্-বাংলা, সাউথইস্ট, প্রাইম, সিটি, ব্র্যাক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এদিকে ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ডলারে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছেÑ এমন আরো অন্তত ১০টি ব্যাংকের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মতো মানি চেঞ্জারদের ক্ষেত্রেও ডলার বেচাকেনায় ব্যবধান (স্প্রেড) নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংকের সঙ্গে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবধান হবে সর্বোচ্চ এক টাকা ৫০ পয়সা। ব্যাংক ডলার কিনে এক টাকা লাভে বিক্রি করতে পারবে। বুধবার খোলাবাজারে বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ১০ মে’র নির্দেশনায় ডলারের সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার একদিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ব্যাংকের রপ্তানি আয় অন্য ব্যাংকে ভাঙানোর ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় রেট থেকে এক টাকা বেশি দামে ডলার ক্রয় করে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফা করতে বলা হয়েছে। এর আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ মুনাফার সীমা এক টাকা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ডলারের সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি, শিগগিরই বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।
মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর মহাসচিব মো. হেলাল সিকদার বলেন, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা মুনাফার হার সর্বোচ্চ দেড় টাকা পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া ডলারের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে বলে তিনি জানান।
অন্যদিকে আমদানির লাগাম টানতে যেসব শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তার সুফল আসতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের ১১ দিনে দেশে মোট ১৬১ কোটি ডলার সমপরিমাণ মূল্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে; যা জুলাই মাসের ওই ১১ দিনের তুলনায় ৯৪ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ কম। তখন আমদানি হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে দেশে মোট ৫৫৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে; যা জুন মাসের তুলনায় ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ কম। জুন মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের। তবে জুন মাসে অবশ্য মে মাসের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র ৭ শতাংশ বেশি খোলা হয়েছিল। মে মাসে ঋণপত্র খোলা হয় ৭৪৪ কোটি ডলারের।
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যায়। ফলে বিগত কয়েক মাস ধরে আমদানি ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৯৫৪ কোটি (৩৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন) ডলারে। প্রতি মাসে আট বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে মজুদ এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে রাশ টানার উদ্যোগ শুরু হয় গত মে মাস থেকে। গত ৪ জুলাই এক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গাড়ি, সোনা, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে শতভাগ। আর জ্বালানি, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, শিল্পে ব্যবহারের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ কিছু পণ্য বাদে অন্য সবক্ষেত্রে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার হবে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে মার্জিনের জন্য ঋণ দেওয়া যাবে না। এর মানে এলসি খোলার সময়ই আমদানিকারকের নিজস্ব উৎস থেকে পুরো অর্থ নগদে দিতে হবে। এর আগে গত ১০ মে’র নির্দেশনায় ডলারের সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ব্যাংকের রপ্তানি আয় অন্য ব্যাংকে ভাঙানোর ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। ইডিএফ থেকে নেওয়া ঋণ কেবল রপ্তানি আয় বা জমা থাকা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করার সময়ে শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
Leave a Reply