সাকিব আল হাসান, ২২ গজের ভূলোকে বিমোহিত-বিমুগ্ধতা ছড়ানো এক নাম। বিশ্ব সেরার তকমায় আর অপার সব কীর্তিগাঁথায় সাফল্যের শেখরে সমাসীন এক নাম। বাংলার ক্রিকেটের এক মহা স্তম্ভ তিনি, ভূমিকাটা ঐতিহাসিক চীনের প্রাচীরের ন্যায় দূর্ভেধ্য-দূর্বার। এই বঙ্গে উদিত অসংখ্য তারার ভিড়ে তিনি এক সূর্য্যসম, যার শুভ্র রশ্মি ৫৭ হাজার বর্গমাইলের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়েছে দূর দিগন্তে, বিশ্বজুড়ে!
আজ ৩৫ বছরে পা দিলেন বাংলাদেশি পোস্টারবয়। আইপিএলের প্রস্তুতি সারতে রোববার রাতে একাই দেশে ফিরেছেন সাকিব। তাই এবারের জন্মদিনে সাকিব পাশে পাচ্ছেন না স্ত্রী শিশিরকে। কোলে তুলে নিতে পারছেন না সদ্য ভূমিষ্ঠ ফুটফুটে ছেলেসহ দুই মেয়েকে।
মাগুরার ফায়সাল, ড্রেসিংরুমের ময়না আর বাংলাদেশের সাকিব। ক্রিকেটার হিসেবে যে যাত্রা শুরুই হত না নাম্বার সেভেন্টি ফাইভের। সাকিবের পছন্দ ছিল ফুটবল। খেলতেনও তা। পাড়ায় একদিন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে একজন আম্পায়ারের চোখে পড়েন। সেখান থেকে বিকেএসপি-বয়সভিত্তিক হয়ে জাতীয় দলে ডাক পান ২০০৬ সালে। ওই যে শুরু। সাকিব ছুটেছেন নিজস্ব গতিতে। তার নেতৃত্বে দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতে টাইগাররা। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলে বাংলাদেশ। ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই বিশ্বসেরা ক্রিকেটার হন বাংলাদেশের পোস্টার বয়।
এশিয়া কাপের ফাইনালে তার কান্না। অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটে-বলে একাই হারিয়ে দেয়া। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে একাকী লড়ে যাওয়া কিংবা ইংল্যান্ডকে দেশের মাটিতে টেস্টে হারানোর পর তার স্যালুট। সবকিছুই যে বলে দেয় মাথা নোয়াবার নয়। ওয়ানম্যান আর্মি হয়ে দেশকে জিতিয়েছেন বহুবার। ৫ ফুট নয় ইঞ্চির মানুষটা যে তখনো দমে যাননি। তার স্বপ্ন যে আকাশ ছোঁয়া। দেশের হয়ে রেকর্ডবুকের কোন পাতায় নেই সাকিব তা খুঁজে পাওয়াই যেন দুষ্কর। বেস্ট বোলিং ফিগার, সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ উইকেট- সব বিভাগেই প্রথম তিন জনের একজন সাকিব। সারা বিশ্বের প্রায় সব ফ্রাঞ্চাইজি লিগ খেলা একমাত্র বাংলাদেশী। তবে সাকিব আলাদা ভাবে আলোচনায় ক্যারিয়ার জুড়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। নিষিদ্ধ হয়েছেন। তবে সমালোচকদের মুখে কুলুপ এঁটেছেন মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে।
বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের হটকেক সাকিব। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায়ও কাজ করেছেন। জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হয়েছে। আর্ত মানবতার সেবায় নিজ নামে খুলেছেন সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন। এখন তার নয়া প্রজেক্ট মাসকো-সাকিব ক্রিকেট একাডেমীতে ভবিষ্যতের ক্রিকেটার গড়ে তোলা। ২০১২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শিশিরের সঙ্গে। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সাজানো সংসার তাদের। চাঁদের কলঙ্ক বাদ দিলে সবকিছু ধবধবে সাদা। বিতর্ক ছাড়া সাকিবও এমনটাই।
সাকিবের ক্যারিয়ারঃ-
সাকিব আল হাসান তার পুরো ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি মাইলফলক অর্জন করেছেন। ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি খেলার সব ফরম্যাটে ১০,০০০ রান করেছেন এবং ৫০০ উইকেট নিয়েছেন। তিনি ওডিআই ক্রিকেটে দ্রুততম ৫,০০০ রান এবং ২৫০ উইকেটের দ্বিগুণ ছুঁয়েছেন, মাত্র ১৯৯ ম্যাচে এই কীর্তি অর্জন করেছেন।
২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। তিনি ৬০৬ রান করেন এবং মাত্র ৪ ম্যাচে ১১ উইকেট নেন, যা তাকে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এবং উইকেট শিকারী করে তোলে। অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য তিনি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে সাকিব আল হাসানের অবদান অপরিসীম। তিনি ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় এবং ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাদের প্রথম জয় সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনালে অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপ এবং ২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তাদের সেমিফাইনাল উপস্থিতি।
জাতীয় দলে তার অবদান ছাড়াও, সাকিব আল হাসান বিশ্বের বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগের বেশ কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে কলকাতা নাইট রাইডার্স, সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ এবং রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে খেলেছেন। এছাড়াও তিনি ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে জ্যামাইকা তালাওয়াহস, বিগ ব্যাশ লিগে মেলবোর্ন রেনেগেডস এবং ইংলিশ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে ওরচেস্টারশায়ারের হয়ে খেলেছেন।
মাঠের বাইরে সাকিব আল হাসান সক্রিয়ভাবে সামাজিক কাজে যুক্ত রয়েছেন। তিনি একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন যার লক্ষ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তা প্রদান করা। তিনি শিশুশ্রম এবং গার্হস্থ্য সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই সহ বিভিন্ন সামাজিক কারণের জন্য সোচ্চার উকিল ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনঃ- ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর সাকিব আল হাসান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী উম্মে আহমেদ শিশিরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তিনি দুইটি কন্যা সন্তান এবং একটি পুত্র সন্তানের জনক। তার বড় মেয়ের নাম আলাইনা হাসান অব্রি এবং ছোট মেয়ের নাম ইররাম। ২০২১ সালের ১৬ মার্চ (বাংলাদেশ সময়) তৃতীয় সন্তানের বাবা হন সাকিব আল হাসান।
বাংলাদেশের অনেক কিছুর প্রথম তার হাত ধরে। ২৪ মার্চ এই মহানায়কের ৩৩ তম জন্মদিন। পৃথিবীতে চাঁদ-সূর্য একটাই। সাকিব আল হাসানও যে ওই একটাই।
শুভ জন্মদিন সাকিব আল হাসান।
Leave a Reply