
প্রথম পরীক্ষায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন। কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট।
প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় সব কেন্দ্রে এবার ভোট নেওয়া হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে। সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট দেন ভোটাররা। কুমিল্লা সিটি ছাড়াও গতকাল বুধবার পাঁচটি পৌরসভা, চারটি উপজেলা ও শতাধিক ইউপির নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে দুই-একটি ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সার্বিক নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়েনি। ভোটাররা নির্ভয়ে ও স্বস্তির পরিবেশেই ভোট দিতে পেরেছেন। কুমিল্লায় ৫নং ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে ইভিএমে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় ৪২ মিনিট বিলম্বে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। এ ছাড়া আর কোনো কেন্দ্রে ইভিএমের ত্রুটির খবর পাওয়া যায়নি। আর কুমিল্লাসহ কয়েক জায়গায় সকালের দিকে বৃষ্টি কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকা থেকেও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে কুসিকের নির্বাচন মনিটরিং করা, জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা, প্রভাব বিস্তার ও আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে ১১ ‘বহিরাগতকে’ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সার্বিক ভোটের পরিবেশ ছিল সন্তোষজনক। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ভোটগ্রহণের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সার্বিক দিক বিবেচনায় বলা যায়, কুমিল্লা সিটিতে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ভোটারদের কাছ থেকেও তেমন কোনো অভিযোগ আসেনি। এ সিটিতে (কুমিল্লা) প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
বুধবার ভোট শুরুর পর সকাল ১০টার দিকে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি, সবাই সুন্দরভাবে ভোট দিচ্ছেন। বৃষ্টি আসার কারণে ভোটার উপস্থিতি একটু কম। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে আসতে পারেন, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে বলেও জানান তিনি।
কুমিল্লা সিটিতে ৮০০ সিসি ক্যামেরার নজরদারির মধ্যে হয়েছে ভোট; দিন শেষে দেশের ভোটকেন্দ্রে প্রথমবারের মতো নেওয়া এ পদক্ষেপে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কিছু ধরা পড়েনি বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। রাজধানী ঢাকা থেকেই এসব সিসি ক্যামেরায় চোখ রেখে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনের পরিস্থিতি নজরে রাখেন নির্বাচন কমিশনের কর্তা ব্যক্তিরা। কুমিল্লার পাশাপাশি আরো পাঁচ পৌরসভার ভোটেও ৫০০টি ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় স্থানীয়ভাবে ও দূর থেকে ভোট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। ভোটের পরিস্থিতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান বলেন, পুরো নির্বাচন শতভাগ আমাদের নজরে ছিল। ভোট খুব ভালো হয়েছে। কোনো ধরনের অভিযোগ পাইনি। কেন্দ্রে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকসহ সবাই ভোট দেখেছেন। সবাই আমাদের চোখ, তারাই বলবে কেমন ভোট হয়েছে। ইসি সচিবালয় থেকে সবগুলো ক্যামেরা পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার সরাসরি ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
কুসিকের ভোট শুরুর পর বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অনেক। তবে সকাল নয়টার পর বৃষ্টিতে ভোটারদের উপস্থিতিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। ভোট দিতে আসা অনেকে বৃষ্টিতে ভিজে যান। আবার কয়েকটি কেন্দ্র থেকে ইভিএমের কারণে ভোট দিতে বেশি সময় নষ্ট হচ্ছে, এমন অভিযোগ করেন ভোটাররা। ইভিএমে অনভিজ্ঞতার কারণে নানা সমস্যায় পড়েছেন বয়স্ক ভোটাররা। অনেক ভোটারের, বিশেষ করে বয়স্ক ভোটারদের আঙুলের ছাপ মিলছিল না। হাত ধুয়ে, জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে দেখা যায়। ভোটকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। কিছুক্ষণ পরপর ম্যাজিস্ট্রেট ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করছেন।
গোয়ালমথন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, নারী ভোটারদের উপস্থিতি বেশি। বয়স্ক ভোটারদের সমস্যা বেশি হচ্ছে। পরীক্ষামূলক ভোটিংয়ের সময় এই কেন্দ্রের মাত্র ১৩৫ জন এসেছিলেন। তখন বেশি ভোটার এসে ইভিএমে ভোট দেওয়া দেখলে আজকে দ্রুত ভোট দেওয়া যেত। সময় কম লাগতো। এদিকে ইভিএম নিয়ে নানা মজার কাণ্ডও ঘটেছে। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আলিয়া মাদরাসার একটি কেন্দ্রে ভোট দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন মজার ঘটনার কথা জানান প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. নাইমুর রহমান। তিনি বলেন, সকালে এক ভোটার গোপন কক্ষে গিয়ে ব্যালটে চাপ দেওয়ার পর শব্দ শুনে ভয় পেয়ে বের হয়ে যান। তার ভোট অসম্পূর্ণ থাকায় অন্যদের ভোটও নেওয়া যাচ্ছিল না। তাকে বুঝিয়ে ফের ভোট দিতে গোপন কক্ষে পাঠানো হয়। এ ছাড়া দুই ভোটার ইভিএমের ইলেকট্রিক ব্যালটে চাপ দিতে গিয়ে নিচে ফেলে দেন বলেও জানান প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।
সকাল ৯টায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন। জয়ের বিষয়ে কতটুকু আশাবাদী সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।
অপরদিকে, সকাল সাড়ে ৯টায় নির্বাচনে সাবেক মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ১২ নম্বর ওয়ার্ডের হোচ্ছামিয়া বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন। ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ?এখন পর্যন্ত ভোটের পরিস্থিতি ভালোই দেখছি। তবে ইভিএম খুবই স্লো। এ কারণে ভোটগ্রহণে দেরি হচ্ছে। কুসিক নির্বাচনে আলোচনায় থাকা কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ভোট দেওয়ার পর বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) যে ভাষায় আমার কাছে চিঠি দিয়েছে সেটা খুবই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। এলাকা ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া ইসির এখতিয়ার নয়। বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, যেখানেই নৌকা সেখানেই ভোট। আমি নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, কিছু কর্মকর্তা ভোটের উৎসব নষ্ট করতে চায়। অতি উৎসাহী কোনো কর্মকর্তা যাতে ভোটের পরিবেশ নষ্ট না করে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হচ্ছে। কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমার অনুরোধ, যাতে ভোটাররা সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য।
কুসিকে ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা: কুসিকে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা, প্রভাব বিস্তার ও আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে ১১ ‘বহিরাগতকে’ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসক জানান, এই ১১ জনের মধ্যে বজ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে দুই বহিরাগতকে সাত দিনের কারাদণ্ড এবং ফরিদা বিদ্যায়ন কেন্দ্রে তিন বহিরাগতকে তিন দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজা মতিন এবং সোহেল রানা।
২৩ নম্বর ওয়ার্ডে দিদার হোসেন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভোট কার্যক্রমকে ‘প্রভাবিত’ করার অভিযোগে সাতদিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমান। এ ছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শুভাশিস ঘোষ নির্বাচনী আচরণ নিশ্চিত করতে আরেক ব্যক্তিকে তিন দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন। নগরীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পিটিআই স্কুল কেন্দ্রে নির্বাচনী আচরণ ভঙ্গের দায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাহুল চন্দের কাছ থেকে তিন মাসের কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন দুজন। এ ছাড়া দণ্ডিত আরো দুইজনের বিস্তারিত এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার মেয়র প্রার্থী ছিলেন পাঁচজন। তারা হলেন আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু, মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার, কামরুল আহসান বাবুল এবং ইসলামী আন্দোলনের রাশেদুল ইসলাম। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১০৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
Leave a Reply