বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন এবং বিএনপিসহ সরকারবিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমালোচনা-আপত্তির মধ্যেই বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) সংসদে পাস হতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের বহুল আলোচিত বিল। সংসদের আজকের কার্যসূচিতে সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের নিমিত্তে বিধান প্রণয়নকল্পে আনীত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল, ২০২২’ পাশের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের প্রস্তাব করবেন। প্রক্রিয়া শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হবে।
নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের খসড়া গত ১৭ জানুয়ারি অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর ২৩ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল, ২০২২’ সংসদে উত্থাপন করেন। সাত দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ঐ দিন বিলটি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সাত দিন সময় পেলেও পরদিনই, অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে দুটি স্থানে কিছুটা সংশোধনীর সুপারিশ করে সংসদে উপস্থাপনের জন্য প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। গতকাল বুধবার সংসদে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার। সব মিলিয়ে ১০ দিনের মধ্যে বিলটি পাসের প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে।
আইনমন্ত্রী আজ বিলটি পাসের জন্য সংসদে প্রস্তাব করার পর এর ওপর কয়েক জন সংসদ সদস্য জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনীর প্রস্তাব তুলবেন। সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যরা তাদের প্রস্তাবের ওপর সংসদে বক্তব্য রাখবেন। এরপর বিলের দফাওয়ারি আনা বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হবে। আলোচনা শেষে কণ্ঠভোটের মাধ্যমে স্পিকার সেগুলো নিষ্পত্তি করবেন। সংসদ চাইলে সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ কিংবা সংসদে যেরকম স্থির করা হবে, সেভাবেই খসড়া আইনটি পাশ হবে। সাধারণত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ সংসদে গ্রহণ করা হয়। বিলটি সংসদে পাশের পর রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিলে সেটি আইনে পরিণত হবে। তখন এই আইনের অধীনেই রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সার্চ কমিটির সুপারিশের পর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। উল্লেখ্য, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে বর্তমান ইসির মেয়াদ।
স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার শর্তে দুটি পরিবর্তন আনার সুপারিশ করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার গতকাল সংসদে বিলটির ওপর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। সংসদে উত্থাপিত বিলে সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতাসংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছিল, সিইসি ও কমিশনার হতে সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই ধারায় সংশোধনী এনে সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশা’ যুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
এছাড়া অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বিলের ৬ (ঘ) ধারায়ও কিছুটা পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছিল, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সিইসি ও কমিশনার হওয়া যাবে না। এখানে দুই বছরের কারাদণ্ড উঠিয়ে শুধু ‘কারাদণ্ড’ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে যেকোনো মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য হবেন না।
আগের সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের বৈধতা প্রদান আজ পাশ হতে যাওয়া বিলটিতে এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠন করা সর্বশেষ দুটি ইসি গঠনেরও বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এর আগে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত সার্চ কমিটি, তাদের কাজ এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ বৈধ ছিল বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
সার্চ কমিটি গঠন ও এর কর্মপ্রক্রিয়া বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সিইসি ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রতিটি পদের বিপরীতে দুই জন করে মোট ১০ জনের নাম প্রস্তাব করার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। বিলটিতে বলা হয়, সার্চ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে দেবে। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। আর কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
আজ শেষ হচ্ছে অধিবেশন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসদের চলতি অধিবেশন সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে। গত ১৬ জানুয়ারি শুরু হওয়া বছরের প্রথম এই অধিবেশন আজ শেষ হতে যাচ্ছে। শেষ দিনে সকাল-বিকাল দুই বেলা বৈঠক চলবে।
Leave a Reply