দেশে করোনার সংক্রমণ অনেকটাই কমে এসেছিল গত বছরের শেষভাগে। ওমিক্রনের প্রভাবে আবার তা বাড়তে শুরু করে। দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু দিন দিন বাড়ছে- গণমাধ্যমে এমন খবর জনমনে চিন্তার ভাঁজ ফেললেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেঁধে দেয়া বিধি নিষেধ মানার ক্ষেত্রে তাদের প্রবল অনাগ্রহ। সরকার ও বিশেষজ্ঞরা মাস্ক ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধিসহ ঘোষিত বিধিনিষেধ মেনে চলার পরামর্শ দিলেও এসব কথা যেন কর্ণপাতই করছে না সাধারণ মানুষ। সরকারের নির্দেশনা যাদের মানানোর কথা তাদের মধ্যেও রয়েছে গা ছাড়া ভাব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া নানা নির্দেশনা, বিধিনিষেধ এখনো বিদ্যমান। চালু আছে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’। কিন্তু কেউ এসব নির্দেশনা, বিধিনিষেধ মানছে না। মাস্ক যারা পরছেন তাদের অধিকাংশই সঠিক নিয়মে পরছেন না। জনসাধারণের এই অসচেতনতা ব্যক্তি নিজে, তার পরিবার ও সামাজিক জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৫ দফা নির্দেশনা দেয়। ১৩ জানুয়ারি থেকে ১১ দফা বিধিনিষেধ পালনের নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয় ১০ জানুয়ারি। গণপরিবহনে ১৫ জানুয়ারি থেকে বিধিনিষেধ শুরু হয়। ২১ জানুয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহ বন্ধ করাসহ ছয় দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। ২৪ জানুয়ারি থেকে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিসগুলো অর্ধেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়ে চালানোর আদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জারি করে ২৩ জানুয়ারি। গত ২৪ জানুয়ারি সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সব অফিসে অর্ধেক জনবল নিয়ে পরিচালনার মতো সরকারের চলমান বিধিনিষেধগুলো আরো বাড়ানো হবে কিনা তা জানা যাবে এক সপ্তাহ পর।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, হোটেল ও রেস্তোরাঁ থেকে খাবার সংগ্রহ বা বসে খাবার খেতে হলে টিকা সনদের প্রয়োজন হবে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, তা যাচাই করছে না হোটেল ও রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। তারা কেবল নিজেদের ব্যবসা ঠিক রাখতে ব্যস্ত সময় পার করছে। গণপরিবহন অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। এর জন্য ভাড়া বাড়বে না- সরকারের এই সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানান গণপরিবহন মালিকরা। তারা জানান, যত আসন তত যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলবে। পরে তাদের সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয় সরকার। কিন্তু নিজেদের কথাই মানছে না গণপরিবহন মালিক শ্রমিকরা। দাঁড় করিয়ে এমন কি ঠাসাঠাসি করেও যাত্রী নিচ্ছে গণপরিবহনগুলো। সংক্রমণ বাড়ায় পরামর্শক কমিটি বাণিজ্যমেলা বন্ধের সুপারিশ করা হলেও তা মানা হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সভা, সমাবেশ, বিভিন্ন আয়োজনের কথা বলা হলেও সেটিও কার্যকর হয়নি। প্রজ্ঞাপন জারির পর গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না এবং মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালিত হলেও এখন সেটিও দেখা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত জনস্বাস্থ্য পরামর্শক কমিটির (সিলেট বিভাগ) সদস্য সিনিয়র ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সরকার নির্দেশনা দিচ্ছে। বলা হচ্ছে মানুষ মানছে না। তাদের মানানোর দায়িত্ব তো সরকারের। সুসংগঠিত হয়ে সমন্বিতভাবে নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। জনগণ ভুল করবে। তাদের পরিবর্তন করার জন্য চেষ্টা কি করেছি? সেই উদ্যোগটা দেখা যায়নি। নমুনা পরীক্ষা বাড়িয়ে দিয়ে বেশিসংখ্যক সংক্রমিত ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে পারলে সংক্রমণ বাড়বে না। মাস্ক আমাদের পরতেই হবে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, সংক্রমণ বাড়লেও প্রকৃত চিত্রটা এখনো আমাদের অজানা। জনগণ মানছে বলে দায় এড়ানো যাবে না। তাদের মানাতে হবে। বুঝাতে হবে। জনগণকে এসব কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক দল, ইমাম, পুরোহিতদের এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকায় তা কার্যকর হয়নি। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বিধিনিষেধগুলো কার্যকর করতে সাংগঠনিক যে ‘অ্যাপ্রোচ’ প্রয়োজন ছিল সেই পথে সরকার হাঁটেনি। ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে নির্দেশনাগুলো মানলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হয়নি। ‘কমিউনিটি মোবিলাইজেশন’ গুরুত্ব পায়নি। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত কমিটি রয়েছে। কিন্তু আমরা সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারিনি। বাণিজ্যমেলা বন্ধ হয়নি। কিছুদিন পিছিয়ে বই মেলাও শুরু হবে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলো। কারণ ওমিক্রনে শিশুদের সংক্রমণ বাড়ছিল। সরকার ঝুঁকি নিতে চায়নি বলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে। মানুষ বিধিনিষেধ মানছে না- সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ করলেও বিধিনিষেধগুলো মানার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ তেমন দেখা যায়নি। সংক্রমণ বাড়ছে। এভাবে যদি বাড়তেই থাকে তাহলে সমস্যা আরো গভীর হবে। সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে জনগণকে বিধিনিষেধ মানাতে হবে।
Leave a Reply