আত্মহত্যা কি?
আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজেই ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম যন্ত্রণা ও কষ্ট দেয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানোর নামই আতহত্যা। ইসলামি দৃষ্টিকোণে আত্মহত্যা একটি জঘন্যতম মহাপাপ। আল্লাহ মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে একমাত্র আল্লাহই জন্ম দেন এবং একমাত্র তিনিই মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বান্দা স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে নিজের হাতে নিয়ে নিজেই নিজকে হত্যা করে ফেলে। এ কারণে এটি একটি গর্হিত কাজ। কবিরা গুনাহ। মহান আল্লাহ তায়ালা এমন কাজকে মোটেই পছন্দ করেন না। এ কারণে যদিও শরিয়তে নির্দেশনায় আত্মহত্যাকারীর জানাযা হয় তবু রাসূল (সা.) নিজে কখনো আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়াননি। সাহাবিদের দ্বারা তা পড়ানো হয়। আত্মহত্যা ইসলামি শরিয়তে জঘন্যতম একটি পাপ, যার একমাত্র শাস্তি জাহান্নাম। নবিজি সা: আত্মহত্যাকারীর জানাজা আদায় না করা থেকেই অনুমান করা যায় যে আত্মহত্যা কত বড় পাপ। আত্মহত্যা ইহকাল পরকাল উভয়টি ধ্বংস করে দেয়। যে কোনো কারণেই হোক না কেনো আত্মহত্যা মহাপাপ। জঘন্যতম পাপ। আত্মহত্যা প্রসঙ্গে রাসুল সা: কঠোর হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারণ করে গেছেন।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?
আগেকার দিনের ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। সাংসারিক কলহ-দ্বন্দ্বে পড়ে, অতিরিক্ত রাগের কারণে, কাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু লাভ করতে না পারলে, নিরাশ বা বঞ্চিত হওয়ার কারণে, লজ্জা ও মানহানিকর কোনো কিছু ঘটে যাওয়া বা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রকাশ হওয়া, অভাব- দারিদ্র্যতার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার অসুখ-বিসুখে জর্জরিত হওয়ার কারণেও আত্মহত্যা হতে পারে। এছাড়াও আরো যে সব কারণে আমাদের সমাজে জঘন্য এই কাজটি ঘটে, তা হলো- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, যৌতুকের কারনে ঝগড়া বিবাদ, পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, প্রেম-বিরহ, মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়ে, ব্যবসায় বারবার ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি।
যখন জ্ঞান-বুদ্ধি-উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজকে অসহায়-ভরসাহীন মনে হয়, তখনই মানুষ আত্মহত্যা করে বসে। আল কোরআনে আত্নহত্যা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা আত্মহত্যা কর না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল। (সুরা নিসা : ২৯)। আল্লাহ তায়ালা কালামুল্লাহ শরিফে বলেছেন- ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না।’ (সূরা বাকারা; ১৯৫ আয়াত)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,- ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করেন।’ (সূরা জুমার; ৫৩ আয়াত)। আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে জগতে বিপর্যয় সৃষ্টি বা হত্যার শাস্তি ব্যতিরেকে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে জীবন্ত রাখে সে যেন সব মানুষকেই জীবন্ত রাখে। (সূরা মায়িদা : ৩২ আয়াত)
হাদিসে আত্নহত্যা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিলো, সে আহত হয়ে ছটফট করতে লাগল। এ অবস্থায় সে ছুরি নিয়ে নিজেই নিজের হাত কাটল ও ব্যাপক রক্তপাত ঘটল। এতে করে তার মৃত্যু হলো।’ আল্লাহ এ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার এ বান্দা নিজের ব্যাপারে খুব তাড়াহুড়া করে ফেলছে। এ কারণে আমি তার প্রতি জান্নাত হারাম করে দিয়েছি।’ ( বোখারি : ৩২৭৬)। আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবিজি সা: বলেছেন,-‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং এটিই হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর এটা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে তা নিজ পেটে ঢুকাতে থাকবে, আর সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
হজরত জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ রা: রাসুল সা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,- ‘একজন ব্যক্তি জখম হলে, সে (অধৈর্য হয়ে) আত্মহত্যা করে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ বললেন, ‘আমার বান্দাহ আমার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের জীবনের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বোখারি)।
এছাড়া আরো কিছু হাদিস এই প্রসঙ্গে আলোচনা এসেছে, ক. সাহাবা আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ঐভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। খ. যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ঐভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে। গ. যে কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে। ঘ. রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোজখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে।
আত্মহত্যা একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি। মাঝেমধ্যেই পত্রিকার পাতায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হতাশ নারী-পুরুষ বেছে নেয় আত্মহননের দুর্ভাগ্যজনক পথ। ইসলামে আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেশুনেও যাদের পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা দুর্বল, তারাই ধ্বংসাত্মক ও মর্মান্তিক ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়।
তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস নয়, সৃষ্টির পথে এগিয়ে যেতে হবে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীও এমন দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত নন। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ছাড়াও আত্মহত্যা যেমন যুবক ও প্রৌঢদের মধ্যে দেখা যায় ; তেমনি তা নারী-পুরুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। মূলত ধৈর্যের অভাবেই মানুষের মাঝে এমন একটি মহাপাপের বিস্তার ঘটছে। এছাড়া শয়তানের কু-প্ররোচনা তো আছেই। সব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে ইসলামের আইন ও অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই কেবল এই মহাব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আত্মহত্যার মতো মহাপাপ থেকে বাঁচার এবং বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করার তওফিক দান করুন। আমিন।
ইসলামে আত্মহত্যা মহাপাপ ও অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। আমাদের সমাজে অনেক লোক আছে, যারা জীবনযাপনের কঠিন দুঃখ-দুর্দশা ও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে পরিত্রাণের জন্য অথবা আবেগের বশবর্তী হয়ে বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে নির্দেশিত হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর করুণাময়।’ -সূরা আন নিসা: ২৯-৩০
পারিবারিক বিপর্যয় কিংবা মানসিক অশান্তিসহ নানা সঙ্কটে ইসলাম মানুষকে ধৈর্যধারণের কথা বলেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ -সূরা বাকারা: ১৫৩
কারণ আল্লাহতায়ালা দুনিয়াকে পরীক্ষাগার বানিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই, মাঝে-মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও।’ –সূরা আল বাকারা: ১৫৫
দুনিয়াতে ভালোমন্দ সবই থাকবে। তবে যেকোনো পরিস্থিতে নিরাশ হওয়া যাবে না। কারণ মুমিন কখনও নিরাশ হতে পারে না। শয়তান মানুষকে নিরাশ করে দেয়। আর অধিকাংশ মানুষ হতাশা আর নৈরাশ্য থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কারণ তার সামনে আপাতদৃষ্টিতে বেছে থাকার সকল উপায় রূদ্ধ।
আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘বলো, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেন। সন্দেহ নেই, তিনিই ক্ষমাশীল দয়ালু।’ -সূরা যুমার: ৫৩
তাই নিরাশ হওয়া যাবে না, কারণ নিরাশ হওয়া কুফরির নামান্তর। দুনিয়ার কষ্ট লাঘব করার জন্য মানুষ আত্মহত্যা করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কষ্টকে লাঘব করেনি বরং নিজেকে এক সুনিশ্চিত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। হাদিসে আত্মহত্যাকারীর ব্যাপারে জঘন্য হুঁশিয়ারী এসেছে।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও তার সেই যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, তার সেই যন্ত্রণাকেও জাহান্নামে অব্যাহত রাখা হবে।’ –সহিহ বোখারি
কোরআনে কারিমে এমন কিছু আয়াত রয়েছে, যেগুলো আমাদেরকে জীবনের প্রকৃত অবস্থাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিছু আয়াত রয়েছে যা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কীভাবে নিজেরাই নিজেদের জীবনটাকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দেই। আর কিছু আয়াত রয়েছে যা আমাদেরকে জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, ভয় হাসিমুখে পার করার শক্তি-সাহস জোগায়।
এ জন্য আমরা নিজেদের এবং সন্তানদের অঙ্কুর থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলি তাহলে আমাদের সমাজ ধীরে ধীরে আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হবে।
আত্মহত্যার শাস্তি সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের এক ব্যক্তি আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। সে একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়।’ এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
আল্লাহতায়ালা আমাদের এ অমার্জনীয় জঘণ্য অপবাদ থেকে বেছে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
Leave a Reply