ঐতিহাসিক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে জাতীয় স্লোগানে রূপান্তরিত করার জন্য সার্কুলার দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বাধ্যতামূলকভাবে সকলকে এই স্লোগান ব্যবহার করতে হবে।
রবিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দুই একদিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
মন্ত্রিসভা জাতীয় স্লোগানের সিদ্ধান্ত নিলে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় অ্যাসেম্বলি শেষে জয় বাংলা স্লোগান দিতে হবে। জাতীয় দিবসে সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষ করতে হবে জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণ করে। সাংবিধানিক পদধারীরাও বক্তব্য শেষ করবেন জয় বাংলা বলে।
রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুন আহসান এবং বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের দ্বৈত বেঞ্চ জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার রায় দেয়। তিন মাসের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা থাকলেও তা হয়নি। কিন্তু এবার ৭ মার্চের আগেই আদালতের এ নির্দেশনা প্রশাসনিকভাবে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
২০১৭ সালে ড. বশির আহমেদ ও ২০১২ সালে আব্দুল বাতেন ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করার জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রায়ে তিন দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। ক. ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে। প্রতিপক্ষগণ অবিলম্বে এ ঘোষণা কার্যকরী করার জন্য পদক্ষেপ নেবেন। অর্থাৎ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন। খ. যাতে সব জাতীয় দিবসে এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারীগণ এবং রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয়/সরকারি অনুষ্ঠানের বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করবেন। সে জন্য প্রতিপক্ষগণ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এবং গ. যাতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অর্থাৎ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ^বিদ্যালয়ে সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি) সমাপ্তির পর ক্ষেত্রমতে সভা-সেমিনারে ছাত্র-শিক্ষকগণ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন, তার জন্য প্রতিপক্ষগণ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
রিট আবেদনকারী বশির আহমেদ গতকাল শুক্রবার রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার এটা নানা কারণে বিলম্বিত করেছে। অবশেষে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আদালতের নির্দেশনাটিকে সরকার প্রশাসনিকভাবে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। মন্ত্রিসভা বৈঠকের মাধ্যমে বিষয়টি কার্যকর করা হবে। এ-সংক্রান্ত সারসংক্ষেপও প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন। ৭ মার্চের আগেই প্রজ্ঞাপন জারি হবে।’
যেখানে মাদ্রাসাগুলোতে অ্যাসেম্বলি হয় না, জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, সেখানে কীভাবে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া হবে জানতে চাইলে বর্ষীয়ান এই আইনজীবী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে একটা মামলা হয়েছিল। দেশটির অনেক লোক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। ইউএসএর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্লোগান হচ্ছে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’ যা বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘আমাদের বিশ্বাসে ঈশ্বর’। এই স্লোগান স্কুলে চালু করার পর একজন অভিভাবক ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেন। তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি, এটা ভুল বিশ্বাস। আমাদের সন্তানকে আমরা স্কুলে পাঠিয়ে ভুল শিক্ষা দিতে পারি না। ডিসি কোর্টের মামলা হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। সেখানে বিচারক রায় দিয়েছেন, এই ঈশ্বর তোমাদের সেই ইশ^র নয়, এ ঈশ্বর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দেশপ্রেমের ঈশ্বর। এই চেতনার ঈশ্বরে শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে বাংলা-ইংরেজি ভাষা পড়ি, আরবিও এমন একটি ভাষা। ভাষা যা-ই হোক আমাদের চেতনার জায়গায় দেশপ্রেম থাকতে হবে। সেই ‘ইন গড উই ট্রাস্টে’র মতো চেতনার বলে বলীয়ান হতে হবে। আর জয় বাংলা স্লোগানটা ঠিক সে কাজটিই করে। কাজেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা যা-ই হোক না কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ স্লোগান দিতে হবে চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য।’
বশির আহমেদ তার রিট আবেদনের রেফারেন্সে ইন গড উই ট্রাস্টের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আদালতে তথ্য প্রমাণ দিয়ে জানিয়েছেন, ১৬৬টি দেশে সাংবিধানিক স্লোগান রয়েছে। ১২টি দেশে জাতির পিতাকে স্লোগানে রেখে সম্মানিত করা হয়েছে। বিশে^র দরবারে জয় বাংলার অনন্য ইতিহাস রয়েছে।
বশির আহমেদ আরও জানান, ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে ভাষা স্মরণ সপ্তাহ ছিল। সেখানে বলা হয়েছিল জয় বাংলা স্লোগানের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা আছে। তাই জয় বাংলার আবেদনটা চিরঞ্জীব। ধর্মকে দিয়ে চেতনার জায়গা রুদ্ধ করা উচিত না।
প্রায় চার বছর আগে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছিল। জয় বাংলাকে কেন জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে আদালতের সেই নোটিসের ওপর দীর্ঘ সময় শুনানি হয়েছে। এ সময় বশির আহমেদ সারা বিশ্বের জাতীয় স্লোগানের আদ্যপান্ত তুলে ধরেন।
জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার নির্দেশানার রায়ে আদালত উল্লেখ করে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগান জনগণকে তাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশে-বিদেশে একটাই স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। এ ছাড়া পাকিস্তানেরও কিছু কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এক হয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দিয়েছেন।
জয় বাংলা স্লোগানটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হলেও কালে কালে এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতা যোগ হয়েছে। আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় সভা-সমাবেশে জয় বাংলা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি এই স্লোগানের বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ব্যবহার করে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জয় বাংলা কোনো দলের সেøাগান নয়, এটি আমাদের জাতীয় প্রেরণার প্রতীক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দলমত-নির্বিশেষে জয় বাংলা প্রধান স্লোগান হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। অপারেশন শুরু করার আগমুর্হূতে জয় বাংলা বলে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সফল অপারেশন শেষে বা যুদ্ধ জয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে জয় উদযাপন করতেন।’
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, জয় বাংলা স্লোগান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ব্যবহার হয়। এই অঞ্চলের লোকেরা বাঙালির ঐক্য বোঝাতে এর ব্যবহার করে থাকে। এর আগে বাঙালি কখনো এত তীব্র ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি, যাতে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ। পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে এখনো জয় বাংলা স্লোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তৃণমূল গত নির্বাচনে এ স্লোগান ব্যবহার করে বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে উজ্জীবিত করে এবং নির্বাচনে বিজিপির বিরুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা স্লোগানটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় বাংলা উচ্চারণ করে ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভা শেষ করেন। এই ভাষণের পর থেকে এটি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয় বাংলা, বাংলার জয় গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে বলে জানান শাহরিয়ার কবির।
মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া জানায়, জয় বাংলার উৎপত্তি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারীপুরের স্কুলশিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পূর্ণচন্দ্রের আত্মত্যাগে মুগ্ধ হয়ে তার কারামুক্তি উপলক্ষে কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থর ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি। এখানেই কাজী নজরুল প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
Leave a Reply