আজ ১৭ রমজান। ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। এ দিন ইসলাম ও মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঘুমিয়ে পড়া জীর্ণশীর্ণ মুসলমানকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য বদরের চেতনার চেয়ে কার্যকর আর কিছুই হতে পারে না।
আজ থেকে ১৪৪৩ হিজরি বছর আগে এই দিনে মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে ক্বেরামের ৩১৩ জনের একটি মুজাহিদ বাহিনী বদর প্রান্তরে উপস্থিত হন। ইসলামের ইতিহাসে যাকে জঙ্গে বদর বা বদর যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইসলামের ঐতিহাসিক এ যুদ্ধের এই দিবসকে আল্লাহ্পাক পবিত্র কোরআনে ইয়াওমুল ফুরক্বান বলে ঘোষণা করেছেন। মদিনা থেকে প্রায় ষাট মাইল পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের নাম বদর। তখনকার দিনে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির গুরুত্ব ছিল অত্যধিক। এখানেই তাওহীদ ও কুফুর-শিরকের মধ্যে সর্বপ্রথম সংঘর্ষ ঘটে দ্বিতীয় হিজরির ১৭ই রমজানুল মোবারক মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১১ই মার্চ, শুক্রবার। ‘আরব জাতির ইতিহাস’- গ্রন্থে বলেন বদরের যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রকাশ্য বিজয়। এটা ইসলামের ঐতিহাসিক বিজয় ও মুসলমানগণ হিজবুল্লাহ তথা আল্লাহ্র সৈনিক হওয়ার বাস্তব নিদর্শন ছিল। বদর যুদ্ধের গুরুত্ব মুসলিম উম্মাহ্র আছে এক ঐতিহাসিক গৌরবময় দিন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বীর সেনানি মুসলমানদের নাম শুনলে আবু জেহেল, ওতবা, শাইবাসহ শীর্ষস্থানীয় কাফের গোষ্ঠীর পায়ের নিচে মাটি থাকতো না।
বিশ্ব মুসলমানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ধনে-জনে, জ্ঞান-গরিমায় পিছয়ে নেই তারা। নবিজির (সা.) জামানায় না ছিল ধন, না ছিল জনবল, ছিল না কোনো ডক্টরেট-মাস্টার্স করা উচ্চশিক্ষিতের ছড়াছড়ি। আজ সে ইসলাম বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে অঢেল সম্পদ নিয়ে।
বোধহয় এখনকার কথা ভেবেই নবিজি খুব আফসোস করে বলেছেন, একদিন আমার উম্মত অনেক সম্পদের মালিক হবে। হায়! সেদিন তারা ইমানি সম্পদে জীর্ণশীর্ণ জাতিতে পরিণত হবে। দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসের ১৭ তারিখ। বদরের মাঠে কাফেরবাহিনীর এক হাজার সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি মাত্র তিনশ তেরো জন মর্দে-মুমিনের ছোট্ট কাফেলা।
জাগতিক দৃষ্টিতে দেখলে যে কেউই যুদ্ধের আগে মুমিনবাহিনীর নিশ্চিত পরাজয়ের কথা বলে দিতে পারবে; কিন্তু এ বাহিনী তো জাগতিক দৃষ্টির বাইরেও আরেকটি দৃষ্টি অর্জন করেছিল। তা হলো ইমানি দৃষ্টি। জাগতিক অস্ত্র ছাড়ও ইমানি অস্ত্র তাদের কলবের খাপে মোড়া ছিল। তাইতো তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, খেজুর গাছের শুকনো ঢাল হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে চকচকে তরবারিধারীদের ওপর।
বুখারি শরিফের কিতাবুল মাগাজিতে এসেছে, যেসব সাহাবি শুকনো খেজুরের ঢাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, একসময় তারা দেখে খেজুরের ঢাল আর খেজুরের ঢাল নেই। চকচকে তরবারি হয়ে গেছে। সুবহানাল্লাহ। জাগতিক অস্ত্রের মোকাবিলায় ইমানি অস্ত্র এমনই হয়।
আরেকটি ঘটনা, নবিজি (সা.) সৈন্যবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আবেগময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। একপর্যায়ে বলছেন, ওই জান্নাতের দিকে ছুটে আসো, যা আসমান ও জমিনের চেয়েও বড়। ন্যায়েরপক্ষে লড়াই করে শহিদ হলে এমন দশটি পৃথিবীর সমান একটি জান্নাত তোমাকে দেওয়া হবে। পাশেই একজন সাহাবি খেজুর খাচ্ছিলেন। যখন জান্নাতের কথা শুনলেন, তখন বললেন, বাহ! কী চমৎকার জান্নাত বানিয়ে রেখেছেন আল্লাহতায়ালা। আমি যদি হাতে থাকা খেজুরগুলো খেতে থাকি, তাহলে তো জান্নাতে যেতে খুব দেরি হয়ে যাবে। এ বলে হাতের সব খেজুর ছুড়ে ফেলে সে চলে যান ময়দানে।
জগতের মানুষ ভরসা করে জাগতিক উপকরণের ওপর। মুমিন ভরসা করে আল্লাহর ওপর। তাইতো রাসূল (সা.) যুদ্ধ শুরুর আগে আগে আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বারবার বলছিলেন, হে আল্লাহ, এত বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার শক্তি এ ছোট্ট মুমিন বাহিনীটির নেই। আজ যদি এ মুমিনবাহিনী হেরে যায়, তাহলে তোমাকে আল্লাহ বলে ডাকার আর কেউই থাকবে না। এভাবে দোয়া করে রাসূল (সা.) ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। আল্লাহর সাহায্য নাজিল হলো। বিশ্বাসীরা জয়ী হলো।
এই যে অস্ত্রের বলে নয়, দোয়ার ফলে বিজয় লাভ-এটাই বদরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আফসোস! আজ মুসলমানের সব আছে, শুধু ইমানি শক্তিতে তারা হয়ে পড়েছে জীর্ণশীর্ণ। পৃথিবীর এখানে-ওখানে অন্যায়-অসত্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, মানবতার মুখে চুনকালি মেখে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোল চালানো হচ্ছে, হায়! মুসলমানদের সাহায্যে মুসলমান এগিয়ে আসছে না।
বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- আর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরে, যখন তোমরা ছিলে অসহায়। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১২৩)
আরো ইরশাদ হয়েছে- (হে নবী ) স্মরণ করুন যখন আপনার প্রভু নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদের যে, আমি তোমাদের সাথে রয়েছি। সুতরাং তোমরা মু’মিনদের অবিচলিত রাখো। আমি অবিশ্বাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চারিত করে দেবো। অতএব তাদের ঘাড়ের ওপর আঘাত হানো এবং আঘাত হানো তাদের সর্বাঙ্গে। (সূরা আনফাল, আয়াত-১২)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বিজয়ী বেশে মদিনায় ফিরে আসেন, তখন তার এই বিজয় ও সাফল্যে মদিনা ও আশপাশের এলাকায় তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রচুরসংখ্যক মানুষ ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনি আগেই বিজয়ের সংবাদ দিয়ে দু’জন বিশেষ দূত মদিনায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের একজন ছিলেন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি এসে বিজয়ের সংবাদ শোনাতে থাকেন এবং বলেন, হে আনসার সম্প্রদায়, আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তা এবং কাফেরদের হত্যা ও গ্রেফতারি তোমাদের জন্য বরকতময় হোক। কুরাইশদের যেসব নেতা ও বীরপুরুষ এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তিনি তাদের একেকজনের নাম ঘোষণা করতে থাকেন এবং ঘরে ঘরে গিয়ে এই সংবাদ শোনাতে থাকেন। শিশুরা সুর করে ও কবিতার মাধ্যমে এ সংবাদ গেয়ে বেড়াতে লাগল। অন্য দিকে মক্কার ঘরে ঘরে শোকের মাতম বয়ে যায় এবং ইসলামের শত্রুদের অন্তরে ভীতিকর প্রভাব পড়ল। মক্কার দুর্বল ও অসহায় মুসলমানরা যারা হিজরত করতে পারেননি, তারা কাফেরদের পরাজয় ও মুসলমানদের বিজয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন এবং নিজেদের অন্তরে শক্তি অনুভব করেন।
তাই বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ জিহাদ। বিশ্বসভ্যতার মোড় ঘুরে যায় এ থেকে। বদরের প্রান্তর থেকে ইসলামের বিজয়ধারা সূচিত হয়। তাই প্রতি বছর সতেরই রমজান মুসলিম উম্মাহকে স্মরণ করিয়ে দেয় গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস, নতুনভাবে প্রত্যয় জাগায় খোদায়ি কুদরতের অসীমতার সামনে নিজের সব কামনা বিলীন করে দেয়ার ।
Leave a Reply