সরকারি উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ঘাটতি থাকলেও বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, দেশে আত্মহত্যা বাড়ছে ভয়ানকভাবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননের সংখ্যাটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে বা লাইভে এসে আত্মহত্যার বিষয়গুলো নিয়েও তারা চিন্তিত।
দেশের ১৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষার তথ্য বলছে, ১২ থেকে ৬ বছর বয়সিদের মধ্যে ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ আত্মহত্যা করেন। তবে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের বিষয় হলো ৭ বছর বয়সি শিশুও আত্মহত্যা করেছে। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ জানান, ৩৬৪ জন আত্মহননকারীর মধ্যে ১৯৪ জনই ছিলেন স্কুলগামী শিক্ষার্থী। কলেজ শিক্ষার্থী ৭৬ জন, মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ছিলেন ৪৪ জন। কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে ৭৬ জন এই পথ বেছে নেয় যাদের মধ্যে ৪৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ নারী। সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী গত ৮ মাসে আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। বিভাগ অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে ঢাকায়। এই হার শতকরা ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। চট্টগ্রামে ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ, খুলনায় ১৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, বরিশালে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, রংপুরে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, সিলেটে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যা করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানসিক চাপ। এ ছাড়া যৌতুক, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, হতাশা, অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অবসাদ ও হেনস্থার শিকার। বিষণ্নতায় যারা ভোগেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা থাকে বেশি।
এসব কারণ ছাড়াও সংবাদ পরিবেশনের ধরনও আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায় বলে বলছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, প্রায় সময়েই সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয় ‘পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যা’। আর এই ধরনের শিরোনাম পরের বছর পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রটিকেই মূলত আত্মহত্যার উপায় বাতলে দেয়। কারণ, এই সংবাদের শিরোনামেই পরীক্ষায় ফেল করলে কী করতে হবে, সেটির একটি বার্তা তুলে ধরা হয়েছে। সংবাদটিতে আত্মহত্যার ঘটনায় সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে আত্মহত্যাকারীকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ‘নায়কোচিত’ ভূমিকায় রূপান্তর করা হয়। এমনকি এর ফল হয় ভয়াবহ। আত্মহত্যা করলে ‘মৃত আমি’ অনেক সহমর্মিতা পাব যা অনেকটা সামাজিক ন্যায়বিচারের বিকল্প হবে, এই বোধে ঘটতে পারে আরো নতুন আত্মহত্যা। সুতরাং আত্মহত্যা রোধে মিডিয়ার অনেক ভূমিকা রাখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা কেন বাড়ছে- এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও এই কাজটা করে থাকেন। যা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ তৈরি করে। এছাড়া সমাজে সুস্থ সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে কিশোর ও তরুণরা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, করোনায় যত মানুষ মারা গেছে আগামী ৩ বছরে আত্মহত্যায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবেন। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যত উন্নত হবে মানসিক চাপও বাড়বে। তা মোকাবিলায় উদ্যোগ না থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। এই প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর), পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘কাজের মাধ্যমে আশা জাগানো’। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
Leave a Reply